শায়লা জাবীন :
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
মানুষ হতে না পারলে ধর্ম দিয়ে কি হবে ছাই?’
সাধারণত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখি না। হাতের আঙুল এগোয় না। মনও চায় না। খুবই চেষ্টা করি ভুলে থাকার। কিছুটা এড়িয়েও চলি। কে কি বলছে, লিখছে দেখি কিন্তু নিজে কিছু লিখি না। মনের ভেতরের চাপকে সামাল দিতেই এই প্রতিরক্ষামূলক আচরণ। কারণ, আমি জানি কেউ জেগে ঘুমালে তাকে জাগানো কত কঠিন, কেউ সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লে তাকে কিন্তু উঠানো যায়। তাই আর জাগ্রত ঘুমন্তদের জাগাতে চেষ্টা করি না। তাই বলে জেগে থেকে ঘুমানো মানুষদের সংখ্যা কিন্তু নেহায়েত কম নয়, বরং বাড়ছেই।
আমি বরং গল্প বলি : উত্তরবঙ্গের একটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে আমার নানার যে বাড়ি সেটি কিন্তু এক সনাতন ধর্মালম্বীর থেকেই নানা কিনেছিলেন ১৯৫০ সালে। ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পর তারা সপরিবারে দেশটিতে পাড়ি জমান নানার কাছে বিক্রি করে। বিশাল জায়গায় করা একটা উঁচু বাড়ি। বাড়িময় পায়রার আনাগোনা।
চিলেকোঠায় পায়রার বিশাল আবাস। ঘুম ভাঙতো পায়রার বাক বাকুম শব্দে। এখনো ভাবলে মন কেমন করে ওঠে। আমাদের প্রিয় নানাবাড়ি, ছোটবেলার কত সুখের স্মৃতি, আনন্দের মুহূর্ত। একটু বড় হওয়ার পর কেন জানি মনে হতো যারা এককালে ছিলেন, কেমন ছিলেন? দেখতে, কথায়, কতটুকু মনে করেন বাড়িটার কথা? আর তো এলেন না।
কোন গোপনে মন পুড়েছে যাওয়ার সময় আজো জানি না কিন্তু অনুভব করতে পারি সেই ব্যথা, নিজে যখন দেশ ছেড়েছিলাম তখন। এই বিশাল শূন্যতা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়, হয়তো শুধুই ব্যস্ততার ভিড়ে চাপা দেয়া যায়।
শুনেছিলাম সেই সময়ে অনেক মুসলিম পরিবার ও ভারত থেকে চলে এসেছিল তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে বা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। ভাঙা মন নিয়ে।
এরপর এলো ১৯৭১ সাল। গল্প শুনেছিলাম মা খালাদের কাছে এর ভয়াবহতা, আমার নানার বাবা জমিদার ছিলেন। যুদ্ধের সময় মা, খালা মামাদের নিয়ে নানা গ্রামের বাড়ি চলে যান। গ্রামের একটা বিশাল অংশজুড়ে তাদের বাড়ি, অন্দরমহল, ভেতর উঠান, কলতলা, কুয়াতলা, মধ্যে উঠান, বৈঠক খানা, বাহির উঠান, পুকুরপাড়, কবরস্থান, সুপারি বাগান, নারিকেল গাছের মেলা, আম কাঁঠাল গাছের ছায়া, লাউ ডগার মায়া সবকিছুই একটা বাড়িরই অংশ।
এই বাড়িতেও মিলিটারিরা এসেছিল কয়েকবার মুক্তির খোঁজে। অন্য কিছুর সন্ধানে। একই সময়ে এই বাড়ির অন্দর মহলে প্রতিটি খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল বাড়ির তো অবশ্যই সঙ্গে আশপাশের সব ধর্মের অল্পবয়সী কিশোরী, তরুণী মেয়েরা। ওই অঞ্চলের একমাত্র নিরাপদ জায়গা।
পাক মিলিটারিদের দৌড় তো বৈঠকখানার পর্যন্ত, আর বড়জোর গাছের কচি ডাব। এর বেশি সাধ্য ছিল না, নানার সামনে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার যুদ্ধ করেছে কোনো না কোনোভাবে। তার পরেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মমতা চোখে পড়ার মতো।
তারা আবারো নিজ দেশ ছাড়লেন দলে দলে। মন ভাঙলো দুই বাংলাতেই। মনের কষ্টের কোনো পরিমাপ যন্ত্র নেই! ভাগ্গিস নেই। এসবের অনেক পরে আমার জন্ম, আশির দশকের পড়তির দিককার সময়, আমরা তখন রাজাবাজার থাকি, ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়ি। আমার মায়ের খুবই শখ হলো আমাকে গান শেখাবেন। দোতালার কমলা দিদি শেখেন, পাশের বিল্ডিংয়ের নিপা এসে যোগ দেয়।
গানের স্যার (১৯৯০ সালে তিনি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। জানি না এখন কোথায় আছেন।) সপ্তাহে দুই তিন দিন আসেন, আমার মা কমলা দিদির মা। মাসিকে বলে আমাকেও গান শেখাতে ঢুকালেন। স্যার এলেই কমলা দিদি দরজায় নক করে বলে যায়। আমরা চারতলায় থাকতাম।
গানের খাতা নিয়ে আমি নেমে যেতাম, মাঝে মধ্যে নিপাদের বাসতেও স্যার বসতেন। আমাদের বাসায় খুবই কম আসতেন। উল্লেখ্য, তারা সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী ছিলেন, আমি ছাড়া। সকালে আরবি হুজুরের কাছে কায়দা পড়ি, দুপুরে স্কুল, সন্ধ্যায় গানের স্যার। কখনো বাড়তি কিছু মনে হয়নি।
এভাবে এক দিন গানের ক্লাসে স্যার স্বরলিপির পর একটা নতুন গান শেখাচ্ছেন। আমাকে বললেন তোমার এই গান গাইতে হবে না, তুমি স্বরলিপিগুলো দেখো বা শোনো। এটা পূজা পার্বণের গান। শুনে মনটা এত খারাপ হলো কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। চুপচাপ কমলা দিদি আর নিপার গাওয়া শুনলাম এবং গানটা এত পছন্দ হলো যে শিখেও ফেললাম। বাসায় এসে অনুশীলন করি, এখনো পারি!
পরের দিন গানের ক্লাসে স্যারকে বলে ফেললাম, গানটা আমিও পারি এখন, গেয়ে শোনাই? তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন কখন শিখলে? কেন শিখলে? মানা করেছিলাম তো তোমায় ততক্ষণে আমার গাওয়া শুরু।
‘প্রণাম জানাই ওগো আমার সুর ও ধাত্রী বীনাপানি
শুভ্র তোমার দেহের ভূষণ,
হংস তোমার সে তো বাহন
বীনা তোমার সুরের মায়া
দাও গো মোদের শুধা বাণী’
গান শুনে স্যারের চোখে পানি। একটুও আড়াল করার চেষ্টা করলেন না, স্মিত হেসে বললেন আশীর্বাদ করি যেমন আছো আজীবন তেমন-ই থাকো।
এরপরের স্যার গান শেখালেনÑ
‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।।
ধূলির ধরা বেহেশ্তে আজ,
জয় করিল, দিলরে লাজ।
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।’
স্যার কিন্তু গানটা আমাকে একা শেখাননি, আমার সঙ্গে নিপা আর কমলা দিদি ও খুশি মনে গেয়েছিল। কেউ মানুক না আর না মানুক ভালোবাসা নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে চলে। কোনো কিছু বা কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে সেটা জীবনে ফেরত আসে, আজ বা কাল। সম্মানও তাই দিলেই পাওয়া যায়।
জানি না তারা আজ কোথায়। ১৯৮৯ সালে আমরা রাজাবাজার এলাকা ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে উঠে যাই। ছিঁড়ে যায় একটা বিনি সুতার বন্ধন। এখনো খুঁজে বেড়াই নিপাকে, কমলা দিদিকে।
এরপরে এক দিন স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ি মনে হয়। টিফিন পিরিয়ডে বকুল গাছ তলায় ফুল কুড়াচ্ছিলাম, এক বান্ধবী বলে উঠল লাল পিঁপড়া লাল পিঁপড়া। মার মার মেরে ফেল। হিন্দু তো কামড়ে দেবে! এত অদ্ভুত লাগল কথাটা যে ফুল কুড়ানো থামিয়ে দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম, মেয়েটার নাম মনে আছে, বলছি না এখন।
তাকে বললাম পিঁপড়ার আবার হিন্দু মুসলিম কি রে? বলল কালো পিঁপড়ারা মুসলিম, ভালো। কামরায় না। লালগুলো কামড়ায়। জিজ্ঞাসা করলাম লাল পিঁপড়াগুলো হিন্দুদের কামড়ায় না? সে উত্তর দিলো না, বলল জানি না! পরের ক্লাসে আর মন বসে না। বিষণ্ন মনে বাসায় এলাম স্কুল ছুটির পর। আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন, বললেন কোনো দুষ্ট মেয়ে তোমার সাথে মজা করেছে!
ধর্ম শুধু মানুষের জন্য, কারণ তাদের প্রয়োজন। অন্য প্রাণীরা অনেক সভ্য, ওদের লাগে না। আমি ওই ঘটনার পর আর কোনোদিন ওই মেয়েটার সঙ্গে পাশাপাশি বসিনি, এড়িয়ে গেছি, মন টানেনি। এখন বড় হয়ে বুঝি কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছোটবেলাতেই মগজে ঢুকানো হয় পরিবার থেকে।
অনেক বছর হলো প্রবাসী, বলতে গেলে আমি নিজেই সংখ্যালঘু এ দেশে। কিন্তু কোনো দিন কোনো ধর্মের মানুষ দ্বারা কোনো বুলিং বা নিপীড়নের স্বীকার হইনি। উল্টা অনেক অনাকাক্সিক্ষত সুবিধা ও সম্মান পেয়েছি। অস্ট্রেলিয়া দেশটি প্রচণ্ড রকমের মাল্টিকালচারের এক অদ্ভুত সুন্দর সহাবস্থান।
এখানে সবাই সবাইকে সম্মান করে। আমার একটা প্রতিবেশীও মুসলিম না। সবার সাথেই স্বদভাব আছে, চাকরিতেও আমার ধর্মের মানুষ খুবই কম। তবুও কখনো মনে হয়নি আমি সংখ্যায় কম।
কেউ যদি আপনার ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে, ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেয়। দিক না এতে তো সে নিজেই তাকে এবং তার ধর্মকে ছোট করল। তার মানসিক অপরিপক্বতার পরিচয় দিলো। আপনি কেন তাকে আঘাত করে নিজেকে ছোট করবেন?
সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান কেউ কি এমনটা বলেছেন? কেউ বলেছেন?
অন্যকে আঘাত করে ছোট করার যে কাপুরুষতা, অশালীন মনোভাব সেটা কবে স্বমূলে বিনাশ হবে জানি না, শুধু জানি যে অন্যকে আঘাত না করেও বড় হওয়া যায়, নিজের বিশালতা দিয়ে, সহনশীলতা দিয়ে, মহানুভবতা দিয়ে। নিজের জানার পরিধি বাড়িয়ে।
‘ধর্ম শুধুমাত্র মনুষ্য প্রজাতির শৃঙ্খলার জন্য সৃষ্টি,
বিশৃঙ্খলার জন্য নয়।
অন্য কোনো প্রাণীর ধর্ম লাগে না, কারণ তারা এমনিতেই সুশৃঙ্খল।’
লেখক : অস্ট্রেলিয়াপ প্রবাসী।