লতিফা চৌধুরী
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর হৃদয় ছোঁয়া অপূর্ব অনুবাদ গ্রন্থ ‘স্পষ্ট জ্যোতি’- পবিত্র আল কুরআনের সমসাময়িক বাংলা অনুবাদ। তার দীর্ঘ ২০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনূদিত বইটি নিঃসন্দেহে বিশ্ব ও তার সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানতে আগ্রহীদের জন্য এক বিরাট উপহার।
আমার সদ্য প্রকাশিত ‘ফেলে আসা দিনগুলি’ বইটি তার হাতে দিয়ে ধন্য হবার আকাক্সক্ষা নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার বাসায় গিয়েছিলাম- সঙ্গে ছিল টেলিভিশনের শাহিদা আরবী ও বন্ধু রানু মোহসিন। আব্বাসী ভাই সারাদিন একটা টিভি প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং একটু আগেই বাসায় ফিরেছিলেন। আমাদের আসার খবর পেয়ে আব্বাসী ভাই আর আসমা ভাবী দুজনেই তাদের পরিপাটি বসার ঘরে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই সেই চির পরিচিত প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। হাতে দিলেন ‘স্পষ্ট জ্যোতি’র একটি খণ্ড।
আমার ১৬ বছর বয়স থেকেই আব্বাসী ভাইকে চিনি । আমি তখন সবেমাত্র গান শিখছি। আবদুল লতিফ সাহেবের সঙ্গে এক দিন সেগুন বাগিচায় প্রতিষ্ঠিত ভয়েস অব আমেরিকার ছোট্ট রেকর্ডিং রুমে বসেছিলাম বাচ্চাদের জন্য ছড়ার গান রেকর্ডিং করার জন্য। সেদিন আব্বাসী ভাইয়েরও পল্লী সঙ্গীতের রেকর্ডিং ছিল। সে দিনই তাকে প্রথম দেখলাম। একজন দীর্ঘদেহী, সুদর্শন গৌরবর্ণ, মুখে হাসি, সঙ্গে কৌতুক এবং সুকণ্ঠ থেকে মাঝে মধ্যেই আবেগে গান গেয়ে উঠছেন- এমনই একজন আকর্ষণীয় যুবক। স্টুডিওতে উপস্থিত সকলকে তিনি পরম শ্রদ্ধায় আপনজনের মতো সম্মান জানিয়েছিলেন। উপস্থিত সকলেও তাকে সন্তানতুল্য স্নেহে গ্রহণ করছেন দেখে বুঝতে পারলাম তিনি মহান শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের সুযোগ্য সন্তান। একবার তার শয্যাশায়ী পিতাকেও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বোন ফেরদৌসী আপাকে দূর থেকে শুধু দেখেছিলেম, কিন্তু কাছে যাবার সাহস হয় নি। যাহোক, আব্বাসী ভাইয়ের গানের রেকর্ডিং শুরু হবে; কিন্তু মন্দিরাটা বাজাবে কে? কাউকেই পাওয়া গেল না। এসময় রেকর্ডিস্ট হাই সাহেব আমাকে বললেন ‘তুমিই তো বাজিয়ে দিতে পার, শুধু তালে তালে টুকে দেবে’। আমি ছোট যন্ত্রটা হাতে তুলে নিতেই আব্বাসী ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলেন ও হেসে উঠলেন। সেদিন থেকে আমি তার আদরের ছোট বোন মঞ্জু আর তিনি আমার বড় ভাই আব্বাসী। আজ আমি সত্তরোর্ধ কিন্তু সম্পর্কটা তেমনই আছে। দেখা না হলেও অন্তরের শুভ কামনা জানিয়ে যাবই। তার উপস্থাপনা ও পরিচালনায় বি-টি-ভি-তে ‘ভরা নদীর বাঁকে’ এবং আরও কত অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। টিভিতে পল্লীগানের অনুষ্ঠান থাকলে আমি প্রায়ই তাঁর সঙ্গে সহশিল্পী হবার গৌরব লাভ করতাম। মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য তিনি প্রায়ই আমাকে আগে গান গাইতে বলতেন। তখন দেখতাম তিনি স্টুডিরও এক কোণে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন। স্টুডিওর বাইরে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করতে একসঙ্গে অনেক শিল্পী মিলে সিলেট গিয়েছি। পথে সারারাত ট্রেনে আমরা সবাই গান গেয়েই সকালের সূর্য ওঠা দেখেছিলাম সেদিন। সেই সব স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না।
অনেকে বলেন আব্বাসী ভাই নাকি হঠাৎ করেই পাল্টে গেছেন। আমার ধারণা তার মতো মানুষকে জানতে হলে, বুঝতে হলে শুধু বাইরে থেকে তাকে দেখে অনুমান করে মন্তব্য করা চলে না। এই মানুষটা কে? কি তার পরিচয়? কার সন্তান? তিনি কোন সময়ের মানুষ? তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কত মহিমান্বিত। উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণ, আদব-কায়দা সবই গভীরভাবে ছায়া ফেলে পরিবারের সদস্যদের শৈশব-কৈশোর ও পরিণত যৌবনে। একজন পরিণত মানুষ হিসেবেও পারিবারিক শিক্ষাকে তারা লালন করেন সযতেœ। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন একটি একান্নবর্তী পরিবারের নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলার আবর্তে। সঙ্গে পেয়েছেন সঙ্গীতের স্বর্গীয় আনন্দধারা। ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি তাকে বিমোহিত করত আশৈশব। শিক্ষিত জ্ঞানী সঙ্গীতজ্ঞ পিতার সঠিক পরিচর্যায় ব্যক্তিজীবন গড়ে তুলেছেন অত্যন্ত মজবুতভাবে। তার মধ্যে নেই কোন হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ও অযাচিত অর্থলিপ্সা। অগাধ পা-িত্য আর সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি এই পৃথিবীর মহান স্রষ্টা সুন্দরতমকে চিনেছেন। চেতনায় ধারণ করেছেন অসীম বিশ্বাস। আর সেই অটল বিশ্বাস বুকে নিয়ে আজ তিনি স্রষ্টার কাছে নিবেদিত। ‘স্পষ্ট জ্যোতি’ অনুবাদ করা তাকেই মানায়। কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালা তো সবাইকে এ পরম সৌভাগ্য দান করেন না- সেই সৌভাগ্য অর্জন করতে হয়। আব্বাসী ভাই তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে তা অর্জন করেছেন। আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ, কিন্তু বিশ্বাস করি আল্লাহ্ তাঁকে গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলনে, চোখে মুখের উচ্ছ্বাসে, সুরেলা কণ্ঠস্বরে এমন আনন্দময় হয়ে ওঠেন সেই হৃদয়ের গভীরে পাওয়া বিশ্বাসের জোরেই।
অগাধ পা-িত্য তাকে এনে দিয়েছে অপূর্ব লেখনী ক্ষমতা। তার অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর সৌন্দর্য তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন এবং বইয়ের পাতায় পাতায় অপূর্ব বর্ণনায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। শুধু নিজে দেখেননি অপরকেও দেখিয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে এমন পরিতৃপ্ত মানুষ আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। কারণ আমরা আসল সুন্দরকে চিনতে চাই না। তাই না পাওয়ার অতৃপ্তি মানুষের জীবনকে বিড়ম্বিত করে। আমাদের প্রায় সকলেরই আরো চাইÑ সব চাই। অথচ যাবার সময় কিছুই নিতে পারি না সঙ্গে। আব্বাসী ভাইয়ের ‘স্পষ্ট জ্যোতি’ মন দিয়ে পড়লে কিছুটা শান্তি মানুষ পেতে পারে- অন্ধকারে আলো জ্বলতেও পারে।
সেজদাতেই আব্বাসী ভাইয়ের পরম তৃপ্তি ও নির্মল শান্তি। অলৌকিকভাবে তিনি বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হন নি। এসেছেন ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে সঠিক পথ ধরে সত্যের আলো হাতে নিয়ে পরম বিশ্বাসের দরজায়। ‘স্পষ্ট জ্যোতি’ তাকে জ্যোতির্ময় করেছে। এই জ্যোতি হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি একদিন সেই মহাজ্যোতির্ময়ের দেখা পাবেন এই দোয়া করি। আল্লাহ তাকে সুস্থ ও সুন্দর জীবন দান করুন।
মাঝে মধ্যে ভেবে দুঃখ পাই- অবাক হই এমন একজন মানুষকে আমরা সঙ্গীত জগতের মানুষরা কাছে পেয়েও বুঝতে চাইলাম না। তার কাছ থেকে কিছু নিতে পারলাম না বলে। এ আমাদের বড় দৈন্য এবং ক্ষুদ্রতা ছাড়া আর কি। আব্বাসী ভাই যখন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন, তখন শিল্পী আঞ্জুমান আরা এবং আমিও সামান্য সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। আমি খুশি হয়েছিলাম তাকে আরও কাছ থেকে খানিকটা জানতে পারবো, বুঝতে পারবো এই আশায়। তখন দেখেছি তার মধ্যে দেশপ্রেম। দেশের তৃণমূলের গুণী মানুষদের উপরে তুলে আনার এক অদম্য চেষ্টা। কবি জসীমউদ্দীনের উপর দর্শকদের বিরাট উপস্থিতিতে মনোজ্ঞ আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন। যখন আমরা প্রায়ই দেখি নিজের দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের উপেক্ষা করে অন্যদেশ থেকে জ্ঞানী ব্যক্তি বলে কথিতদের আমদানি করা হয়। আব্বাসী ভাইকেও দেখেছি সকল গুণীজনের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখাতে। কিন্তু নিজ দেশকে কিংবা দেশের গুণী-জ্ঞানীদের নিচে দাবিয়ে রেখে নয়। তার কাছে দেশ আর দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সবার আগে। এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষের প্রতি হৃদয় খুলে দেয়া শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই জ্যোতির্ময় মানুষটির এক অসাধারণ বোধশক্তি। এমন মানুষ বাংলাদেশের রত্ন- মানবতার প্রতীক।
আমার মনের কোণে একটি সুপ্ত আকাক্সক্ষা, যদি তার মতো মানুষের পদপান্তে বসে প্রাণভরে একফোঁটা চোখের পানি ঝরাতে পারতাম; তবে হয়তো এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যে থেকেই একটুখানি স্বর্গীয় আনন্দ কুড়িয়ে নিতে পারতাম। যার মুখে মাঝে মধ্যেই ধ্বনিত হতে শুনি ‘আল্লাহ আকবর’- স্ইে মহাসুন্দরতমকে খুঁজে বেড়ানোর মানুষটির কাছে গেলে অল্প কিছু হলেও তো সুন্দরের অনুভব হৃদয়কে শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আব্বাসী ভাইয়ের জন্য দু’হাত তুলে পরম করুণাময়ের কাছে আমার দোয়া থাকবে ‘আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতবাসী করবেন, স্থান দেবেন শ্রেষ্ঠ জান্নাতের এককোণে শান্তির নীড়ে- আমিন!’
ওয়াশিংটন ডি.সি।