
সিনহা এম এ সাঈদ :
এক হাজারের বেশি টকশো করেছি এবং এখনো করছি।
স্থান-কাল-পাত্রভেদে দেশ ও জাতির স্বার্থে যা ভালো মনে করেছি তা-ই বলেছি এবং এখনো বলছি। বলিষ্ঠ, নিরপেক্ষ বক্তব্যের জন্য গ্লোবাল ভয়েস, সিনহা দ্য স্পিকার, আলোকিত সিনহা ইত্যাদি সম্মানেও ভূষিত হয়েছি বিভিন্ন বলয় থেকে। আমার এই দীর্ঘ যাত্রার অভিজ্ঞতা বলে ‘নিরপেক্ষ বলয়’ বলতে এখন আর তেমন কিছু নেই। আর যদি কেউ মনে করেন যে আছে তবে তিনি বা তারা বলয়ের বাইরে নিছক ‘এতিম’ বলেই পরিগণিত হবেন চূড়ান্তভাবে।
মূলত টকশোকে সরকারবিরোধী বলয় মনে করে এটা হবে অবশ্যই সরকারের নিন্দার হাতিয়ার, সমালোচনার নয় (সমালোচনা ভালো-মন্দ দুদিকেরই বাস্তবতা তুলে ধরে করণীয় পদক্ষেপের তাগিদ দেয়)। বিপরীতে সরকার বলয়ের ভাবনা হলো টকশো টক (প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার প্রকাশ্য উক্তি)। কারণ এগুলো সরকারের ভালো কাজের মূল্যায়নে পুরোপুরি নেতিবাচক।
সুতরাং, সঠিক টকশোর শ্রোতা নেহাতই কম। দলকানা ও দল সমর্থকদের ভিড়ে টকশোর মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দূরে সরে যাচ্ছে। চলমান রাজনীতির নেতিবাচক ঝাপটা ও দাপটের কারণেই মূলত এমনটা হচ্ছে। টকশোতে দর্শক- শ্রোতাদের মন্তব্যগুলোর দিকে নজর দিলেই এর বাস্তবতা অতি সহজেই বোঝা যায়।
সবচেয়ে বড় সত্য হলো, টকশোর জন্য পূর্বশর্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ, যার লালন-পালনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো যতটা মৌখিকভাবে সোচ্চার ও জেহাদি, বাস্তবে তার অনেক দূরে অবস্থান করছে।
নিরপেক্ষ বলয় থেকে যিনি কথা বলবেন, তিনি কোনো বলয়েই গ্রহণযোগ্য হবেন না বরং উভয় বলয়ের এবং তাদের সমর্থকদের নিকট বিপরীত বলয়ের তোষামোদকারী বলে বিবেচিত হবেন। এটাই হলো এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বাস্তবতা।
নিজ নিজ দলের দলীয় নেতা-নেত্রীরা টকশোতে দলীয় কর্মকাণ্ডকে ভুলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মনের ভাব ও ভাষার মাধুরী মিশিয়ে বলিষ্ঠ উচ্চারণে যে ধরনের বক্তব্য ও বাগ্্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তা শুধু বিব্রতকর নয়, স্বয়ং বক্তার নিজ ভাবমূর্তির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ বটে।
টকশোর গৃহীত নীতিমালা অনুযায়ী একজন ক্ষমতাসীনদের বলয়ের, একজন বিরোধী বলয়ের এবং ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশ্নে একজন মূলত নিরপেক্ষ বলয়ের। অনেক সময় বিষয়বস্তুর বিচারে সংখ্যা চার/পাঁচও হতে পারে।
বাস্তব চিত্র হলো, দুই বিপরীত বলয়ের বক্তাদের সাংঘর্ষিক অবস্থান, বক্তব্য, যুক্তি উপস্থাপন ও খণ্ডনের ভাষা টকশোর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ধূলিসাৎ করে দেয়। বেচারা সঞ্চালক বিব্রতবোধ করতে থাকেন এবং দুই পক্ষকেই সংযত করতে হিমশিম পর্যায়ে উপনীত হতে বাধ্য হন। নিরপেক্ষ অবস্থানের বক্তা স্বভাবতভাবেই অসহায় হয়ে পড়েন।
সার্বিক বিচার ও বিশ্লেষণে এগুলো টকশোর মাত্রায় অবস্থান করা নয়। তবে কয়েকটি টকশো সাড়া জাগাতে পেরেছে বহুবিধ কারণে। এখানে সঞ্চালকের ভূমিকা, বিষয়বস্তু ও বক্তা নির্ধারণ মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রা এবং কানাডাভিত্তিক অনলাইন চ্যানেল ফেস দ্য পিপল। এদের মধ্যমণি জিল্লুর রহমান ও সাইফুর রহমান সাগর যথেষ্ট পারদর্শিতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন।
দেশপ্রেম এখন দলীয় খাঁচায় আবদ্ধ। এর সংজ্ঞা আজ পরিবর্তিত। দলপ্রেমের মাধ্যমেই দেশপ্রেম প্রকাশিত ও বিকশিত হতে হবে, যার দলপ্রেম নেই তার দেশপ্রেম নেই। অতএব, নিরপেক্ষ বলয় একধরনের ভাঁওতাবাজি ও আত্মপ্রতারণার শামিল।
হায়রে স্বাধীনতা!
হায়রে বাংলাদেশ!!
হায়রে রাজনীতি!!!
হায়রে রাজনীতিবিদ!!!
এ লজ্জা রাখিব কোথায়?
লেখক : কলামিস্ট
০৫ মে ২০২৩, ঢাকা, বাংলাদেশ