আব্দুর রহমান চৌধুরী
শুক্রবার বাগদাদসহ ইরাকের সর্বত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। আসলে শুধু ইরাক নয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো দেশেই শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাগদাদে তাই জাতিসংঘের স্থানীয় অফিসগুলো শুক্রবারকে ছুটির দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে। তেমনি এক ছুটির দিনে এক সহকর্মীকে সাথে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে ফেরার পথে টাইগ্রিস নদের তীরে সূর্যাস্ত দেখতে এক জায়গায় বসে পড়লাম। গ্রীষ্মের বিকেল, তাই অনেকেই সস্ত্রীক নদের তীরে বেড়াতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমির, জীবন জুড়ালে তুমি। টাইগ্রিস ইরাকিদের কাছে হয়তো তেমনি জীবন জুড়ানো এক নদ।
টাইগ্রিস তুরস্ক থেকে সিরিয়ার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে মসুল শহরের কাছে এসে ইরাকে প্রবেশ করে। দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাগদাদ শহরকে প্রায় দ্বিখ-িত করে মহানগরী কারবালার পাশ দিয়ে অবশেষে শাতিল আরবে মিশে একাকার হয়ে যায়। অন্যদিকে ইউফ্রেটিস নদ দেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাসরার কাছে শাতিল আরবে যোগ দিয়ে পারস্য উপসাগরে বিলীন হয়েছে। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস ইরাকের গৌরব-অতীত ও বর্তমানের উত্থান-পতনের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে আছে।
টাইগ্রিস আমাদের মেঘনা নদীর মতো প্রশস্ত। তবে আমাদের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতো সর্বগ্রাসী নয়। বর্ষায় টাইগ্রিস লোকালয় ভাসিয়ে দেয় না। তেমনি প্রায় মৌসুমে নদীর মাঝে চর গজিয়ে উঠে না। বছরের সব সময়ই নির্দিষ্ট পরিমাণ জল প্রবাহকে নিশ্চিত করে। ভাঙা-গড়ার খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে না। এদিক দিয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা টাইগ্রিসের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। টাইগ্রিসের অতীত এমন হয়তো ছিল না। দ্বাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন আর আগের জায়গায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাচীন ভবনটি টাইগ্রিস গ্রাস করে ফেলছে বহু বছর আগে। টাইগ্রিসে নৌ চলাচল নেই বললেই চলে। সড়ক পথেই লোকজন বেশি চলাফেরা করে। একসময় রেল যোগাযোগ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরবর্তীতে পিছিয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বিমান চলাচলও বন্ধ। তাই দেশের ভেতরে ও বাইরে যাতায়াতের একমাত্র উপায় হচ্ছে উন্নতমানের সড়ক ও জনপদগুলো। মহাসড়কে ৪/৫টি করে লেন। চালকরা নির্দ্বিধায় ৬০ থেকে ৮০ মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে যায়। সড়কে দুর্ঘটনার খবর খুব একটা শোনা যেত না।
এই সড়ক পথেই আমি ইরাকের বিভিন্ন শহরে গিয়েছি। কোথাও কোনো সময় যানজটের সম্মুখীন হতে হয়নি। দেশের বাইরে যেতে হলে সড়ক পথেই জর্ডানের রাজধানী আম্মানে আসতে হতো। বাগদাদ থেকে আম্মান আসতে প্রায় এগারো ঘণ্টা সময় লাগতো। ট্রেবিল সীমান্তে ঘণ্টা খানেকের জন্য আসতে হতো ইমিগ্রেশন ফরমালিটিজের জন্য। সীমান্ত শহরে ইমিগ্রেশন অফিসের পাশেই ছোট্ট বাজার ছিল। প্রচুর পরিমাণে ফল পাওয়া যেত। চা, কফির দোকানে আমাদের অনেক সময় ভালোভাবে কেটে যেত। আম্মানে এসে আমরা সচরাচর যাত্রা বিরতি করতাম। পরের দিন বিমানে ঢাকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যাতায়াতের সুযোগ ছিল।
একবার বাগদাদ থেকে মসুল যাচ্ছি। আমার সাথে এক জার্মান সহকর্মী। পথে সালাহউদ্দীন শহরে এক রেস্টুরেন্টে থামলাম। চা-নাস্তা খেলাম। বের হওয়ার সময় বিল পরিশোধের জন্য টাকা ম্যানেজারের সামনের টেবিলে রাখলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বিলসহ টাকাটা আমার দিকে ঠেলে দিলেন। যখন আমি বললাম, বিলের টাকা দিচ্ছি তখন তিনি সাহাস্যে জবাব দিলেন, আমরা মেহমানের কাছ থেকে টাকা নেই না। তার মহানুভবতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম। এটাই হচ্ছে ইরাকিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
নাজাফ যাচ্ছি। বাগদাদ থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। মহাসড়কে ৮০ মাইল বেগে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে লোকালয় চোখে পড়ে। রাস্তার দু’পাশেই সুবিশাল মরুভূমি। এই নাজাফ শহরেই হযরত আলী(রা) এর মাজার। অনতিদূরে কুফা শহরেই তিনি আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে আহত হয়েছিলেন। কুফা শহরের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই, নাজাফ শহরের মধ্যে বিলুপ্তি ঘটেছে। হযরত আলী(রা)এর মাজার ঘিরেই বিরাট মসজিদ। শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান। প্রতি বছর লাখ লাখ শিয়া মুসলমান নাজাফ ও কারবালা জিয়ারত করতে আসেন। একদল ঐতিহাসিকের মতে হযরত আলী(রা) এর বিরোধীরা নাজাফে তার সমাধিস্থ করার ঘোর আপত্তি করায় তার অনুরাগীরা উঠের পৃষ্ঠে তার মরদেহ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে রওয়ানা দেন। আফগানিস্তানের বাল্ক প্রদেশে আসার পর হযরত আলী (রা)কে সেখানকার এক জনপদে সমাধিস্থ করেন। বর্তমানে সে জনপদের নাম মাজারে শরীফ বাল্ক প্রদেশের রাজধানী। অবশ্য বেশির ভাগ ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন নাজাফ শহরেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। সারা বছরব্যাপী সহস্র সহস্র ধর্মানুরাগী তার মাজার জিয়ারতে নাজাফে আসেন। সাদ্দাম হোসেনের সরকারে সুন্নি প্রাধান্য থাকলেও দেশের কোথাও শিয়া-সুন্নি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কখনো হয়েছে বলে শুনি নি। ছয় লাখ অধিবাসীর বাগদাদ শহরে বহু শিয়া ও সুন্নি পরিবার বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্কিত। বাদগাদ তথা সারা দেশেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল।
হযরত আলী(রা) এর মাজারের অনতিদূরে একটি বাড়িতে ইরাকের আয়াতুল্লাহ খোমেনি অনেক বছর ইরাক সরকারের অতিথি হিসেবে ছিলেন। নামাজে মসজিদে আসতেন তবে তার বাড়িতেই রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতেন। ১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ার সরকারের মধ্যস্থতায় ইরান-ইরাক শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতুল্লাহকে ইরাক থেকে চলে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। আয়াতুল্লাহ মর্মাহত হন এবং তার সহকর্মীদের নিয়ে প্যারিসের শহরতলিতে নতুন আবাস গড়ে তোলেন। ১৯৭৯ সালে তেহরানে ফেরার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তÍ প্যারিসেই আয়াতুল্লাহ তার সহকর্মীদের নিয়ে শাহবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ২০০২ সালের মাঝামাঝি ইসরাইল অবরোধ, নির্যাতন ও ক্রমবর্ধমান বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা সশস্ত্র বিদ্রোহ বা দ্বিতীয় ইন্তেফাদা আরম্ভ করে। জর্জ বুশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে বিদ্রোহ দমনে তৎপর হওয়া কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়। একপর্যায়ে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কলিন ফাওয়েল ইসরাইল সফর করেন। বিদ্রোহ দমনে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাফল্য পর্যবেক্ষণ করে। জেরুজালেমে তার দেওয়া বিভিন্ন বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে, মার্কিন সরকারের সম্মতি নিয়েই ইসরাইল নির্মমতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। যেখান থেকে বৃদ্ধ নারী ও শিশু পর্যন্ত অব্যাহতি পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেরনের নির্দেশে তার সামরিক বাহিনী ইয়াসির আরাফাতের সরকারি বাসভবনের এক অংশ ধ্বংস করে দিয়েছিল। জর্জ বুশ এই শেরনকে ‘ম্যান অব দ্যা পিস’ বলে একাধিক বার সম্বোধন করেছিলেন। প্রথম ইন্তেফাদার সময় ‘সাদ্দাম সরকার’ ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে অর্থ ও বেসামরিক সাহায্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু এবার নিজেই যখন আগ্রাসনের সম্মুখীন তাই প্রতিবেশীর সাহায্যে এগিয়ে আসা থেকে বিরত থাকে।
২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ইরাক-কুয়েত ও ইরাক-জর্ডান সীমান্তে ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন দেশরক্ষা সচিব ও পররাষ্ট্র সচিবের দেওয়া বক্তব্য থেকে ইরাকে সামরিক অভিযানের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। একই সময় জাতিসংঘের নিরস্ত্রিকরণ সংস্থাগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তাই অনেকেই আশাবাদী ছিলেন যে, জাতিসংঘের পাওয়া তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছিল যে, ইরাক সরকারের কাছে কোনো রাসায়নিক অস্ত্রের সরবরাহ নেই। তাই ব্রিটিশ-মার্কিন সরকার ইরাক অভিযান থেকে বিরত থাকবে। সেই মাসে নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্স ও জার্মানি ইরাকে সামরিক অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেছিল।
ডিসেম্বর মাসের একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন আসলো বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব সাঈদ হাসান মাসাওয়ী এক সভার আয়োজন করেন। সন্ধ্যা ৭টার পর তার অফিসে হাজির হলাম। জাতিসংঘের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণও উপস্থিত ছিলেন। প্রারম্ভিক বক্তব্যে মাসাওয়ী বললেন, ব্রিটিশ-মার্কিন সামরিক তৎপরতা অন্যায়। আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। তিনি আরও জানালেন, আইএইএ ও ইউএনমোভিক এর পর্যবেক্ষকগণ কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা পরিদর্শন করে যাচ্ছেন এবং তারা কোথাও কোন রাসায়নিক ও আণবিক সমরাস্ত্রের সন্ধান পাননি। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন কোন যুক্তিতে ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে? মাসাওয়ারী আমাদের অনুরোধ করলেন, আমরা যেন স্বীয় সংস্থাগুলোর প্রধানদের ইরাকের ভূমিকাকে পরিষ্কার ও যুক্তিসিদ্ধভাবে তুলি ধরি। আমরা সকলেই মাসাওয়ারীর বক্তব্যের যৌকিকতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলি, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিগতভাবে সামরিক কর্মকান্ডের বিরোধী। সামরিক অভিযান জনজীবনে ব্যাপক ধ্বংস ও যন্ত্রণা ডেকে আনে। তাই আমরা সবসময়ই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতি। আমি যখন তন্ময় হয়ে টাইগ্রিসের জলপ্রবাহ দেখছি তখন নদীর পশ্চিম তীরে সূর্য প্রায় অস্তমিত হতে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমার কাঁধে হাত রাখছে। ফিরে তাকালাম, দেখি বন্ধু আনোয়ার কারাদাগি। বললেন, আজ আমার বাসায় তোমার নৈশভোজ করার কথা। বললাম, অবশ্যই আমার মনে আছে। কারাদাগির সাথেই প্রথমে আমার হোটেলে ও পরে তার বাসায় গেলাম। কারাদাগি অনেক বছর তেল ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাদে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি কুর্দি সম্প্রদায়ের লোক। বললাম, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কে ছড়িয়ে আছে প্রায় ২৫ লাখ তুর্কি। কিন্তু তাদের কোনো স্বীয় আবাস ভূমি নেই কেন? বললেন, সা¤্রাজ্যবাদি শক্তিগুলো আমাদের মাতৃভূমিকে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছে। জানান, তালেবানের নেতৃত্বে দেশের উত্তরাঞ্চলে কুর্দিস্থান অনেকটা স্বায়ত্বশাসিত। তবে এর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। প্রায় ১৮ লাখ কুর্দি তুরস্কে বসবাস করে। আর তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম বিশ্বের জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। আপাতত কোনো বৃহত্তর কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা নেই। স্বাধীন ও সার্বভৌম ইরাকি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ইরাকি কুর্দিরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের সুযোগ নিয়ে বসবাস করতে পারলেই যথেষ্ট। আমরা সেই বঞ্চিত সুযোগের প্রত্যাশার আছি। আনোয়ার কারাদাগির প্রত্যাশার সাফল্য কামনা করে মাঝ রাতে হোটেলে ফিরলাম।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা।