টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টায় বাড়ছে হুন্ডি

ঠিকানা রিপোর্ট : ‘বৈধভাবে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে খরচ বেশি, তাই বাড়ছে হুন্ডি।’ বিশ্বব্যাংকের এই সতর্কবার্তাকে কানে নিচ্ছে না সরকার। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে মোটা অংকের রেমিট্যান্স যাচ্ছে। ফলে হুন্ডির এই বিপুল অর্থ রেমিট্যান্সে যোগ হচ্ছে না। অবৈধ পথে যত অর্থ যাচ্ছে, বরং সমপরিমাণ অর্থ ডলার হয়ে বিদেশে পাচার হচ্ছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকার টাকার মান ধরে রাখতে গিয়ে হুন্ডিকেই স্বাগত জানাচ্ছে। বিশেষ করে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানো দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৈধপথে দেশে অর্থ পাঠালে ডলারের দাম কমে যাচ্ছে। সঙ্গে দিতে হচ্ছে পাঠানোর খরচ। অন্যদিকে বৈধপথে যেখানে ডলার প্রতি ১০৭ টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে হুন্ডির মাধ্যমে মিলছে ১১২ থেকে ১১৪ টাকা। আবার অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠালে ডলার প্রতি দিচ্ছে ১০৯ থেকে ১১০ টাকা। এরসঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।
অ্যাপভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান ট্যাপট্যাপ সেন্ড ২৩ জানুয়ারি সোমবার সারা দিন প্রতি ডলার ১০৯ টাকা দিয়েছে। সঙ্গে দিয়েছে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। ফলে এক ডলারের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে ১১১ টকা ৫০ পয়সা।
ট্যাপট্যাপ সেন্ড ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেন্ডওয়েভের মাধ্যমে বিনা খরচে রেমিট্যান্স পাঠানো যায়। এছাড়া স্বল্প খরচে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ দিচ্ছে অ্যাপভিত্তিক রেমিটলি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বাংলাদেশে যে কোনো ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠায়। এছাড়া ট্যাপট্যাপ সেন্ড এবং সেন্ডওয়েভ মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশে মুহূর্তে রেমিট্যান্স পাঠানো যাচ্ছে। হাতের নাগালে হওয়ায় বহু প্রবাসী এসব সেবা গ্রহণ করছেন।
তবে বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠাতে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছেন বাংলাদেশি মালিকানাধীন মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সোনালী এক্সচেঞ্জ দীর্ঘ সময় ধরে ভালো রেট দিচ্ছে। এমনকী তারা কোনো ফি নিচ্ছে না। সানম্যান গ্লোবাল এক ডলার সমান ১০৯ টাকার উপরে রেট দিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে তারা কিছু ফি রাখছে।
২৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মূদ্রার সর্বনিম্ন বিনিময় হার ছিল ১০৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এদিন সর্বোচ্চ হার ছিল ১১৭ টাকা। অথচ অন্যান্য বৈধ চ্যানেলেও ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৯ টাকায়। একই সময়ে অন্যান্য বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময় হারে টাকার মান ছিল অনেকে নিচে। এক ইউরো সমান টাকা সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১১৫ টাকা ৬৩ পয়সা। পাউন্ড ১৩০ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু সে হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
এদিকে টাকার মান ধরে রাখতে গিয়ে ডলারের দাম কমে যাওয়ায় বহু প্রবাসী দেশে বৈধপথে যেমন রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন, একইভাবে অনেকে ডলার ধরে রেখেছেন দাম বাড়লে পাঠাবেন বলে। ফলে দেশে ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এই দায়িত্ব পালন করছে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বাফেদা। এরপর দুই সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের দাম নির্ধারণ ক‌রে আস‌ছে। শুরুতে রপ্তানি আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৯৯ টাকা ও প্রবাসী আয়ে ১০৮ টাকা। আর ডলারের পাঁচ দিনের গড় খরচের চেয়ে ১ টাকা বেশি দামে আমদানি দায় শোধ করতে বলা হয়। পরে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বৈঠক করে নতুন দর নির্ধারণ করা হচ্ছে।
সবশেষ ১ জানুয়া‌রি রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম আরও ১ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ১০২ টাকা। অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম কমিয়ে ১০৭ টাকা করা হয়েছে।
এবিবি ও বাফেদা নয়, সংকটে ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। এখন প্রতি ডলার ১০০ টাকা করে বিক্রি করছে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি পণ্য আমদানিতে যে ডলার বিক্রি করছে, তার প্রতি ডলারের মূল্য ১০০ টাকা।
২৩ জানুয়ারি সোমবার এই দরেই রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা। এক বছর আগেও এই ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। তবে খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১১ টাকা। গেল বছর কার্ব মার্কেটে ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
সব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমে যাবে। সেজন্য সরকারের প্রয়োজনেই এখন শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্স গিয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ইউএস ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয় গিয়েছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ইউএস ডলার।