ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
টাকা, টাকা-কড়ি, টাকা-পয়সা, বা অর্থ- সবই সমার্থক। তবে বিত্তের প্রশ্ন এলে এর সাথে অন্যান্য সহায়-সম্বল বা সম্পত্তিও এর মধ্যে এসে যায়। তাইতো বিত্তশালী ও বিত্তহীনের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মানব সমাজে টাকার প্রচলন প্রাগৈতিহাসিক কালের। ধন-সম্পদ আহরণ, অর্থের ভান্ডার গড়ে তোলা কিংবা সম্পদশালী হওয়ার আকাক্সক্ষা, প্রচেষ্টা এবং অন্যের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা মানবজাতির এক আদিম লালসা। এ যেনো অনেকটা অন্যান্য সব স্বার্থপর জীবের মতই মানুষের আদি ও অকৃত্রিম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অথচ, যুগ-পরিক্রমায় অনেক স্বার্থত্যাগী মণীষীদের কণ্ঠে শোনা গেছে এর বিপরীত স্লোগান- ‘অর্থই অনর্থের মূল’। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন না, অর্থ ছাড়া মানুষের সমাজ ও জীবনধারা কি চলতে পারে? আসলে অর্থই আমাদের চালিকাশক্তি। অর্থ-বিত্তহীন জীবন কারোরই কাম্য নয়।
টাকার প্রতি কারো মোহ নেই- এ কথা বুকে হাত দিয়ে সম্ভবত কেউই স্বীকার করবে না! তবে অর্থের সঠিক ব্যবহার, বিনিয়োগ ও সচলতা বজায় রাখতে না পারলে তা সুখ-শান্তি, স্বস্তি ও সাফল্যের হাতিয়ার না হয়ে বরং অশান্তি, অনুশোচনা ও দুঃখ-বেদনার কারণ হয়ে উঠতে পারে। অত্যধিক অর্থ-বিত্ত অনেক সময় অনর্থের দিকে ঠেলে দেয়। বিলাসিতা, কর্মবিমুখতা, আত্মগরীমা, মদ-জুয়া, নেশা ও নারী সম্ভোগ হতে পারে এর অনুষঙ্গ। আবার কেউ কেউ টাকার মোহে এমনটাই অন্ধ হয়ে পড়ে, যার ফলে অর্থ আহরণ ও সঞ্চয়ই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সমাজে সৃষ্টি হয় কিং শাইলকের মত নরপিশাচ! অর্থ-বিত্তের মাপকাঠিতেই তো আমরা মানব সমাজে বিত্তহীন (গরিব)।
নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং বিত্তশালী (ধনবান/ধনী শ্রেণিবিভাগ করে থাকি। অর্থের কারণেই এসব শ্রেণির লোকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আচার-অনুষ্ঠান, চিন্তা-ভাবনা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানার্জন করার সুযোগ-সুবিধার হেরফের খুঁজে পাই।
টাকা উপার্জন ও তার ব্যবহার নিয়ে আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে কিরূপ ঘটনা ঘটতে পারে, তার কিছুটা আলোকপাত করতেই উপরোক্ত পটভূমির অবতারণা। পাঠকবর্গের সম্ভবত মনে আছে যে, আমাদের পরিবারে ছোট আপার (ফিরোজা বেগম, ওরফে লিলি) বিয়ে হয় যখন, তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ভাইদের মধ্যে তখন বড় তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এবার পালা নোয়া ভাই, অর্থাৎ এসএম কারুজ্জামান (ওরফে পাতু) মিঞার। নোয়া ভাই তখন রেলওয়ে বিভাগের ঈশ্বরদী স্টেশনে করণিক হিসেবে কর্মরত। নোয়া ভাই অনেকটা ছোট-খাট ক্বাদের মানুষ। অন্যান্য ভাইদের মত লম্বা না হলেও তাঁকে ঠিক বেঁটে বলা চলে না। মায়ের মুখ থেকে শোনা যে, আমাদের দাদি খুব একটা লম্বা ছিলেন না। সম্ভবত দাদির বংশগতিক বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের দু’ভাই (নোয়া ভাই ও জাহিদ ভাই) ও এক বোন (বড় বু)-এর মধ্যে। নোয়া ভাইয়ের গায়ের রঙটাও ময়লা। তাই বাবা খুঁজে-পেতে পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুরের গোপালপুর গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু ও স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র সুন্দরী মেয়ে গুলনাহার বেগমকে ঠিক করলেন।
যথারীতি নোয়া ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাঁদের সংসারে এলো তিন-চারটে ছেলে-মেয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই নোয়া ভাই বাবাকে চিঠিতে জানালেন যে, তাঁর চোখে বিশেষ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসতে ইচ্ছুক। বাবা তাঁকে ধৈর্য্য ধরতে বললেন এবং ভাল কোনো চোখের ডাক্তারকে দেখাতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু এতে ফল কিছুই হলো না। বছর শেষ না হতেই নোয়া ভাই তার পরিবার-পরিজনকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি গোপালপুরে পাঠিয়ে দিলেন। এর পরের বছরেই নোয়া ভাই তাঁর দীর্ঘ আঠারো বছরের চাকুরি শেষে ইস্তফা দিয়ে সস্ত্রীক ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে ইতনার গ্রামের বাড়িতে ঠাঁই নিলেন।
মেজ ছেলে শাহরিয়ার ডেলিমকে (ওরফে ডেলিম) নানাবাড়িতে রেখে বাকি দু’মেয়ে ও এক ছেলেসহ নোয়া ভাইয়ের পরিবার বাবার সামান্য পেনশনের উপর ভর করে চেপে বসলো। যা হোক, এসময় নোয়া ভাবির মুখে একটা আজগুবি কাহিনী শুনতে পেলাম একদিন। মেজ মেয়ে বিলকিস বেগমের বয়স তখন সবে মাত্র দু’বছর। ঈশ্বরদী রেলওয়ে কলোনির বাসায় থাকাকালীন সময়ে একদিন নোয়া ভাবি মেয়েকে দুধভাত খেতে দিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে কী যেনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ বিলকিসের ভাতের থালার চারপাশে উপর থেকে অনেকগুলো সিকি-আধুলি ও এক টাকার ধাতব মুদ্রা এসে পড়তে লাগলো! রান্নাঘর থেকে ত্বরিৎ নোয়া ভাবি এসে মুদ্রাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গুণে দেখলেন যে, সব মিলিয়ে আড়াই টাকা। রাতে ব্যাপারটা নোয়া ভাইকে খুলে বলার পর ঐসব টাকা তাঁকে দেখালেন। সংসার চালাতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া নোয়া ভাই মনে মনে মহাখুশি। যাক, এখন থেকে মেয়েকে প্রতিদিন দুধভাত খেতে দিলেই গায়েবিভাবে টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে!
ভাবির মনে কিছুটা সন্দেহ থাকায় বললেন
-এ টাকা আমাদের খরচ করা কী ঠিক হবে? চলেন না কোনো পীর-ফকিরের কাছে যাই, এ ব্যাপারে কী করবো তা জানি আগে। মেয়েটার উপর কোনো জ্বীনের আছর হলো নাকি!
-আরে ওসব জেনে আমাদের কী লাভ হবে? তুমি আগে যে টাকা পাইছো, তা আমাদের দাও। বাজার করে আনি!
-এ টাকা দিয়ে বাজার করবো! এটা কী ঠিক হবে?
-ঠিক না বেঠিক, তা পরে দেহা (দেখা) যাবে। তুমি মেয়েটাকে আবার দুধভাত খাতি দিবা। দেহা যাক, আজ আবার টাকা-কড়ি পড়ে কীনা। নোয়াভাই বিজ্ঞের মত প্রস্তাব দিলেন।
প্রথম দিনের কুড়িয়ে পাওয়া সব টাকা পকেটে নিয়ে মহাখুশিতে বাজারে গেলেন নোয়া ভাই। কিনে আনলেন একটা বড় আকারের ইলিশ মাছ। তৃপ্তি সহকারে খাওয়া-দাওয়া হলো। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, মেয়ের মারফতে বড়লোক হবার পথ খুলে দিয়েছে আল্লাহ্তায়ালা!
কিন্তু নোয়া ভাবির মনে একটা আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠলো। জ্বীন-ভূতের আছর হলে তো ভবিষ্যতে মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়তে হবে! এ চিন্তা থেকেই তিনি নোয়া ভাইয়ের অবর্তমানে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের শরণাপন্ন হয়ে সবকিছু ঘটনার বর্ণনা দিলেন।
-মা জননী। আপনার মেয়ের উপর জ্বীনের আছর হয়েছে।
ইমাম সাহেব নোয়াভাবীকে জানালেন।
এরপর টাকা-পয়সা ঝরে পড়ার ঘটনা আরো কয়েকদিন ঘটার পর জ¦ীনের আছর সম্পর্কে নোয়া ভাবির ধারণা আরো স্থায়ী হয়ে জেঁকে বসে! উপায়ন্তর না দেখে তিনি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে গোপালপুরে বাপের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। নিজের মা-বাবার সাথে বিষয়টা নিয়ে মত বিনিময় করলেন। এবং মনস্থ করলেন, কোনো কামেল পীর-ফকিরের দ্বারস্থ হওয়ার।
ইতোমধ্যে আর একটি অবিশ^াস্য ঘটনা ঘটে যায় এ পরিবারে! গোপালপুরে নোয়া ভাবিদের পাড়া-পড়শি এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিলকিসের ওপর জ্বীনের আছর সম্পর্কে কিছুটা জানাজানি ও কানাঘুঁষা চলতে থাকে। একদিন বিলকিসকে তার নানাবাড়ির উঠানে খেলতে দেখে একজন বর্ষিয়সী মহিলা বলে উঠলেন
-কিরে বুবু? তুই নাকি আজকাল বড় কবিরাজ হইছিস? তা আমার মাথা-ঘুল্লি আর শরীলের ব্যথা-বেদনাটা দূর করতি একটা তাবিজ-কজজ দে নারে।
-কী বলছো নানিজান। ঠিক আছে, তুমি আমারে কালা তাগা আনে দেও। আমি তুমার জন্যি তাবিজ আনে দিচ্ছি।
বিলকিসের উপরোক্ত কথা শুনে সবাই তো অবাক! পাঁচ বছরের মেয়ে বলে কী? যা হোক, কে যেনো উঠানে জমে যাওয়া ভীড়ের মধ্য থেকে কারো ঘর থেকে কালো তাগার টুকরা এনে বিলকিসের হাতে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বিলকিস তার নানাবাড়ির অদূরে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত পুকুরের দিকে দ্রুত দৌঁড়াতে শুরু করলো। পুকুরটার উত্তর পাড়ের দিকে শান বাঁধানো সিঁড়ি। চারপাড় ভর্তি নানাবিধ বৃক্ষরাজি। আম-জাম, খেজুর ও কলাগাছ। দু-একটা ব্যাপক শাখা-বিস্তারী বাবলা গাছও বর্তমান। পুকুরে তখন প্রচুর পানি টল-টল করছে। সকাল ১০-১১টার দিককার ঘটনা। পুকুরে দু-চারজন তখন সকালের গোসল সারার জন্য ব্যস্ত। হঠাৎ ছোট একটা মেয়েকে তাদের সামনে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব দিতে দেখে সবাই যেনো কেমন হতবাক! পুকুরের পাড়ে ততোক্ষণে কৌতুহলী জনতার ভীড় বেড়েছে। নোয়া ভাবি চিৎকার করে কাঁদো-কাঁদো গলায় পানিতে নেমে থাকা লোকদেরকে বলতে শুরু করেছেন
-আপনারা আমার মাইয়েডারে বাঁচান। ওরে পানির মধ্যি থেকে তুলে আনেন। ওতো সাঁতার জানে না!
এ কথায় পুকুরে গোসলরত লোকজন এদিক-ওদিক হাতড়ানো শুরু করে দেয়। তাছাড়া পুকুর পাড়ে জমায়েত ভীড়ের মধ্য থেকেও কয়েকজন লাফিয়ে পানিতে নেমে বিলকিসকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু কারো কাছেই বিলকিস ধরা পড়লো না। পনেরো-বিশ মিনিট পরে হঠাৎ পুকুরের এক কোণা থেকে বিলকিস নিজেই পানির উপরে উঠে মাথা ও একটা হাত উঁচু করে সবাইকে অবাক করে দেয়! তার ডান হাতে কালো সুতোয় বাধা দু-দুটো তাবিজ! উপরে উঠে এসে বিলকিস তার নানিজানকে তাবিজ দুটো হাতে দিয়ে বললো
-একটা মাথায় বাঁধবেন। আর অন্যটা কোমরে। আল্লাহ্ চাহে তো আপনার সব বেমারি দূর হয়ে যাবে!
এত অল্পবয়সী ‘জ্বীনে-মুমিন’-এর প্রচার হতে বেশি দেরি লাগেনি। লোকমুখে কিছু সত্য, কিছু বানোয়াট কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের গ্রাম-গঞ্জ থেকেও জনতার ভীড় বাড়তে শুরু হয়। অন্যদিকে নোয়া ভাবির মানসিক দুঃশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পাশের গ্রামের এক কামেল দরবেশ, যিনি জ্বীনের আছর নিয়েও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন, তাঁর শরণাপন্ন হলেন। দরবেশ-ফকির কিছু দোয়া-দরুদ উচ্চারণ করে বিলকিসকে জিজ্ঞেস করলেন
-তুই কোথাথ্ থনে আইছস, তার পরিচয় দে।
-আমি তো এনাগো নানাবাড়ির অনেক পুরানো মেহমান! ভাগ্নিটির নানাবাড়ির থনেই এর সঙ্গ দিয়েছি।
-এত ছোট এক মেয়ের উপর কেন আছর করেছিস?
-ভাগ্নিটারে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। একদিন সন্ধ্যেবেলায় উঠোনে খেলা করার সময় ওর উপর আমার চোখ পড়ে যায়।
-এখন তো কেবলমাত্র ওর বয়স পাঁচ বছর। কয় বছর পর্যন্ত সাথ্ দিবি? মাইয়াডারে ছাড়বি, না কি করবি?
-নয় বছর হলিই আমরা ওরে উঠায়ে নেব আমাদের সম্প্রদায়ে।
এ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই নোয়া ভাবির বুকের মধ্যে শুরু হয় তোলপাড়। কী অলক্ষুণে কথা রে বাবা! মেয়েটাকে শেষে হারাতে না হয়! আর নয় বছরের একটা মেয়ে কোনো পরিবার থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে? নোয়া ভাবি দরবেশ বাবাকে বিশেষ অনুরোধ জানালেন-
-যে করেই হোক, আমার মেয়েডারে এ জ্বীনের খপ্পর থেকে আপনি বাঁচান হুজুর। আপনার হাদিয়া যা চাইবেন, তাই-ই আমি দেবো।
দরবেশ মুখে বিড় বিড় করে আরো কিসব দোয়া-কালাম পড়ে উপর দিকে ফুঁক মেরে বলতে থাকলেন
-ভাগ্নিকে তো তোর ছাড়তেই হবে।
-আমারে বাধ্য করতাছেন ছাড়ার জন্যি! অথচ আমিতো এ পরিবারের ভালোর জন্যিই ভাগ্নিডার উপর ভর করিছিলাম।
-থাক। তোর আর ভালো করার দরকার নাই। তুই এখনই একে ছেড়ে অন্যত্র চলে যা।
-ঠিক আছে। আমি অনেক কষ্ট নিয়ে যাইতেছি। এনাগো পারিবারের ভালো হবে না। ইলিশ মাছ খাইছে আমার টাকায়। এর আঁশটে পড়বে চোখে।
দরবেশের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত বিলকিসের উপর আছর করা জ্বীন চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর বছর দু’য়েকের মধ্যেই খবর এলো যে, নোয়া ভাইয়ের চোখে কী যেন অসুখ ধরা পড়েছে। অফিসের করণিক কাজকর্ম করতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে আসবার জন্য বাবার অনুমতি চাইলেন চিঠি দিয়ে। বাবা চাকরি ছাড়তে নিষেধ করে গার্ডশিপ পরীক্ষা দেবার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ফল তেমন কিছু একটা হয়নি। মাত্র ১২ না ১৪ বছরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পাকশি থেকে নোয়া ভাই সপরিবারে (দুটি মেয়ে ও তিনটা ছেলে) একদিন চলে এলেন গ্রামের বাড়িতে। চাকরির মেয়াদকাল ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়াতে কোন পেনশনও পেলেন না!
সংসার কীভাবে চলবে, নিজেই বা কি করবেন- কোনো চিন্তা-ভাবনার অবকাশ নেই। কিন্তু নোয়া ভাবি বেশ চটপটে, বুদ্ধিমতি মহিলা। বাড়িতে এসেই রান্নাঘরের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিলেন অনেকটা সাগ্রহেই। শাশুড়ির ফাই-ফরমায়েশ ও খেদমত করে অচিরেই হয়ে উঠলেন মায়ের প্রিয় নোয়া-বৌমা। সংসারের চাপ কিছুটা লাঘব করতে নোয়া ভাবি তাঁদের মেজ ছেলেটিকে গোপালপুরে তার নানাবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
নোয়া ভাইয়ের তখন অখণ্ড অবসর। মাঝে মধ্যে মা তাঁকে বাজার করতে পাঠান। সংসারের টুকিটাকি কাজকামে হাত দেন আর শিশু (নবজাত) সন্তানদের দেখাশোনা করে সময় কাটান। মায়ের হাত-বাক্সটি বড়ঘরের পালঙ্কের পশ্চিম দিকে অবস্থিত দরজার পাশে রাখা একটা বড় কাঠের বাক্সের উপর শোভা পায়। হাত বাক্সের চাবিটি মায়ের শাড়ির আঁচলে এক কোণে বাঁধা থাকে। সংসারের সব খরচ পাতির টাকা-পয়সা এ হাত বাক্সেই জমা থাকতো। বুবু-দুলাভাই কিংবা বড় ভাইয়েরা মাঝে-মধ্যে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এলে মিষ্টি খাবার জন্য এক-দুই টাকা বখশিশ দিলে কোথায় রাখবো এ নিয়ে ছিলাম বিপদে। কারণ, মায়ের কাছে জমা রাখলে তা খরচ করা নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হতো। তাই কখনও বা বড়ঘরের উত্তর দিককার অন্ধকার বারান্দায় বাঁশের চটা ও দড়মা দিয়ে ঘেরা বেড়ার খাঁজে কিংবা কখনও পড়ার টেবিলে রাখা একখানা মোটা অভিধানের পাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হতাম। কিন্তু নোয়া ভাইয়ের স্বভাব ছিল সারা ঘর ও জিনিসপত্র হাতড়ে বেড়ানো। হোক না সে স্থান অন্ধকারাচ্ছন্ন কিংবা সূর্যালোকিত! কারণ এ হাতড়ানোর বিনিময়ে তিনি মাঝে-মধ্যে মুনাফা হিসেবে অন্যের লুকানো টাকা-পয়সা হাতিয়ে লোপাট করে ফেলতেন! জিজ্ঞেস করলে বলতেন
-বইপত্রগুলো টেবিলে উপর এলোমেলো হয়ে আছে দেখে একটু গুছিয়ে রাখছি আর কি!
অথচ তার এ হাতসাফাই যে আসলে চৌর্যবৃত্তি, তা নোয়াভাই কোনদিন ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। কারণ, তাঁর এ স্বভাবটাই পরবর্তীতে নোয়াভাইয়ের পঞ্চম ছেলে সরদার উজ্জ্বল হোসেনের (ওরফে উজ্জ্বল) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয় অধিকতর সূক্ষ্ম ও শাণিত হয়ে। এতে আমাদের বংশের সুনাম, যশ ও গরিমা অনেকখানি লাঘব হয়।
ঐা হোক, বাড়িতে অবসর সময়ে ঘরোয়া ব্যস্ত থাকার উদ্দেশ্যে খুব সম্ভবত ছবি ভাই (এসএম শফিকুল ইসলাম) একখানা ক্যারম বোর্ড ও এর গুটি কিনে কাছারি ঘরে খেলার ব্যবস্থা করেন। পরে আমি, নবীর ভাই ও অন্যান্য অনেক খেলার সাথীরা সময় ও সুযোগমত ক্যারম খেলা শুরু করি। মাঝে মধ্যে নোয়া ভাইও আমাদের সাথে যোগ দিতেন। একদিন নোয়া ভাই আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন। ক্যারম খেলাতে আমাকে নাকি হারাবেনই। আমি বললাম
-তাহলে একটা বাজি ধরা যাক! মোট তিন গেম খেলা হবে। আমি যদি জিতে যাই, তাহলে আমাকে কত টাকা দেবেন?
-ঠিক আছে, ছোটকা। আমাকে হারাতে পারলে তোকে পাঁচ আনা দেব!
এই বলে নোয়া ভাই তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে একটা সিকি ও একটা এক আনি মুদ্রা দেখালেন। দেখিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন
-আর তুই যদি বাজিতে হেরে যাস, তাহলে কী হবে?
-ঠিক আছে নোয়া ভাই। আমি হারলে আপনাকেও পাঁচ আনা দেব, এ আমি কথা দিলাম।
পরদিন যথারীতি খেলা শুরু হলো। আমার খেলার সাথীরা ছিল সবাই দর্শনার্থী। পরপর দু’গেমই আমি জিতে গেলাম। তৃতীয় গেম আর খেলার দরকার নেই। আমি আমার বাজির পাঁচ আনা নোয়া ভাইকে তখনই দিতে বললাম। কিন্তু নোয়া ভাই দিচ্ছি বলে তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
একদিন-দু’দিন যাবার পরেও নোয়াভাই আর বাজি ধরার কথা তোলেন না। দেখা-সাক্ষাৎ হলে এবং আমি আমার পাওনা বাজির অর্থ চাইতেই কোনো না কোনো বাহানায় অন্যত্র চলে যান। শেষে আমি বিষয়টা ফয়সালা করার জন্য মায়ের কাছে বিচার চাইলাম, নোয়া ভাইয়ের উপস্থিতিতেই। সবকিছু শোনার পর মা নোয়া ভাইকে নির্দেশ দিলেন
-যেহেতু বাজি ধরে পাতু তুই তোর ছোট ভাইয়ের কাছে হেরে গিয়েছিস, তখন বাজির অর্থ তোকে দিতেই হবে। যেখান থেকে পারিস, শিগগির পাঁচ আনা পয়সা যোগাড় করে ছোটকাকে দিয়ে দেবে, বাবা।
মায়ের কথায় নোয়া ভাই গেলেন তাঁর ঘরে। তখন মা মন্তব্য করলেন
-জানিস রে বাবা! টাকা এমন চিজ, খোদার চেয়ে কিছু উনিশ-বিশ!
প্রবাদটা শুনে আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম
-এ কথার মানে কী মা?
মা উত্তরে বললেন
-টাকা-পয়সা কেউ কাউকে সহজে দিতে চায় না, বাবা! অর্থের মায়া?- বড় কঠিন মায়া। দেখিস, টাকা হাতে পেলে ছোট অবুঝ শিশুও হাত দিয়ে আঁকড়ে রাখে। কাউকেই দিতে চায় না!
সম্ভবত এজন্যই আমাদের সমাজে আর একটি প্রবচন চালু আছে। তা হলো- ‘টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে’। বাবার মুখে এ প্রবাদটি প্রায়শই শুনতে পেয়েছি। কিন্তু এর মর্মার্থের ব্যাখ্যা চাইবার মত সাহস কখনও যোগাতে পারিনি।