টেক্সটবুক থেকে ফেসবুকে অতিমাত্রায় ব্যবহারে শারীরিক মানসিক ক্ষতি

রাজধানী ডেস্ক : কিশোর ও তরুণ সমাজের সারাদিনের সময়ের বড় একটা অংশ দখল করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। একটা সময় ছিল যখন হাতে সবসময় একটা বই থাকত, বাসে ভ্রমণ অবস্থায় কিংবা একটু অবসর পেলেই চোখ পড়ে থাকত সেই বইয়ের পৃষ্ঠায়। দুপুরে খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্য বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে হাতে নেয়া হত হুমায়ূন আহমেদ, শীর্ষেন্দু, সুনীলের উপন্যাস কিংবা তারও আগের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিভূতী ভূষণের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বই, অথবা একটি সাধারণ জ্ঞানের বই। সেটিতে চোখ বুলাতে বুলাতেই ঘুম চলে আসত। কিন্তু এখন সেই বইয়ের যায়গাটি দখল করে নিয়েছে একটি স্মার্টফোন। আর সেই ফোন হাতে নিয়েই ঢুকে পড়ে ফেসবুক নামক বিশাল নিল সাদার জগতে।
ফেসবুকের কারণে অনেকে রাতের ঘুমকে বির্সজন দিচ্ছে। রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে। মনিরুল ইসলাম নামে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি যখন মেট্রিক বা ইন্টারে পড়তাম তখন সন্ধ্যাটা পার হলেই চোখে ঘুম চলে আসত। পড়ালেখার খুব চাপ থাকলে হয়তো সর্বোচ্চ রাত ১২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে রাত ১২টায় কবে যে ঘুমিয়েছি তা মনে পড়ছে না। প্রতিদিন ফেসবুক চালাতে বা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে রাত ২-৩টা বাজে। ২টার আগে তো এক দিনও ঘুমাতে পারি না। আসলে ২টার আগে ঘুমই আসে না চোখে। ফজলে কবির নামে আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি, কোনো না কোনোভাবে এটা আমাদের ক্ষতি সাধন করে। আমি নিজেই যখনি সময় পাই তখনি ফেসবুকে পড়ে থাকি। অনেক সময় দেখা যায় ফেসবুকে এতটাই মগ্ন থাকি যে সকালের নাশতা করতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। রাতে ঘুমানোর আগে ঢুকলে ১টা, ২টা ছাড়া বের হওয়া যায় না, যার ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। আমাদের অজান্তেই এর প্রতিক্রিয়া কোনো না কোনোভাবে আমাদের শরীর, পড়ালেখা, পরিবার, দৈনন্দিন কাজকর্মসহ অনেক কিছুতেই বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বিশ্লেকষরা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে পাঠ্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক ব্যবহার করবেÑ এটা খুবই স্বাভাবিক। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তারা তাদের আকাক্সক্ষা চাহিদা পূরণ করে সেটা আমরাও প্রত্যাশা করি। তবে সেটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সৎব্যবহারের প্রতি সচেতন থাকতে হবে।
শুধু তরুণ সমাজই নয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার কেড়ে নিচ্ছে শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব-কৈশোর। দুরন্তপনার এই বয়সে যখন তাদের দৌড়ঝাঁপ আর মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করার কথা তখন তাদের কাছে খেলাধুলা আর বিনোদন মানেই হচ্ছে সারাক্ষণ স্ক্রিনে চোখ মগ্ন হয়ে থাকা। যুক্তরাজ্যে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৩-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার, ই-রিডার্স, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য স্ক্রিনভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পেছনে। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। গত বছর ৩১ ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান মতে, মাসে অন্তত একবার ফেসবুক ব্যবহার করেন এমন লোকের সংখ্যা ২১৩ বিলিয়ন। গত বছর এপ্রিলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আড়াই কোটি। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ঢাকা। ফেসবুক, ভায়োলেন্স এন্ড সেইফটি অফ চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে আট বছর বয়সের শিশুরাও ফেসবুক ব্যবহার করছে। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৪ শতাংশ শিশু স্বীকার করেছে তারা ১৩ বছরের কম বয়সী হলেও নিয়ম অমান্য করে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে।