ট্রাম্পকে নিয়ে মার্চ ম্যাডনেস

বাহারুল আলম :

প্রতিবছর মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ বাস্কেটবল প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে তরুণ-ছাত্র-যুবা ও বাস্কেটবলপ্রেমী মানুষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ও উন্মাদনা সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যেটাকে মার্চ ম্যাডনেস (March Madness) নামে অভিহিত করা হয়। খেলা দেখা, খেলার ফলাফল এবং কে কেমন খেললো- তা নিয়ে চলে সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ।

বাস্কেটবল খেলা নিয়ে মার্চ ম্যাডসেন ছাড়াও এ বছর মার্চ মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়েরের কারণে তার সম্ভাব্য গ্রেফতার নিয়ে একধরনের রাজনৈতিক ম্যাডনেস সৃষ্টি হয়, যা মিডিয়াসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও উত্তেজনার জন্ম দেয়।

এই ম্যাডানেসের সূত্রপাত হয় ১৮ মার্চ ট্রাম্পের দেয়া এক টুইট বার্তা থেকে। বার্তায় তিনি জানান, জনৈকা যৌন তারকাকে তার কথিত ঘুষ প্রদানের (Hush Money) ঘটনায় আদালতে অভিযোগ দায়েরের ভিত্তিতে ২১ মার্চ তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। এর প্রতিবাদে তিনি তার সমর্থকদের সোচ্চার হবার আহ্বান জানান। তার ভাষায়Ñ ‘Protest, Protest, Take our nation back’। তাকে গ্রেফতারের খবরটি ট্রাম্প ছাড়া অন্য কোন সূত্র থেকে প্রকাশ করা হয়নি। যে কারণে কেউ কেউ এটাকে ট্রাম্প কর্তৃক তার নিম্নমুখী জনপ্রিয়তাকে চাঙ্গা করার একটি প্রয়াস (Background Noise) বলে মনে করেন।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রায় সাত বছর আগে, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে, পর্নোস্টার স্টর্মি ড্যানিয়েলস ১০ বছর আগে ট্রাম্পের সঙ্গে সংগঠিত তার কথিত যৌন সম্পর্ক ফাঁস করে দেয়ার হুমকি নেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ট্রাম্পের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিব্রতকর হবে মনে করে তাকে চুপ রাখার জন্য ট্রাম্প তার সাবেক আইনজীবীদের একজন মাইকেল কোয়েনের মাধ্যমে পর্নোস্টারকে চুপ রাখার জন্য এক লক্ষ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ প্রদান করেন বলে অভিযোগ করা হয়। কোয়েন নিজের তহবিল তেকে ট্রাম্পের নির্দেশে ঐ টাকা প্রদানের কথা স্বীকার করেন। পরে ট্রাম্প তাকে ঐ টাকা পরিশোধ করে দেন বলে তিনি জানান। ট্রাম্প অবশ্য স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক এবং কোয়েনের মাধ্যমে তাকে অর্থ প্রদানের অভিযোগকে সর্বৈব মিথ্যা বলে দাবি করেন। ডিএ আলভিন ব্রাগ ট্রাম্প ক্যাম্পেন ফাইন্যান্স আইনের কোন লংঘন করেছেন কিনা- সেটা খতিয়ে দেখে নিউইয়র্কের ২৩ সদস্যের গ্র্যান্ড জুরি প্যানেলের অধিকাংশ (১২ জন) জুরির অভিমত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।

গ্র্যান্ড জুরি দীর্ঘ এক বছর তদন্ত শেষে তাদের মতামত জানাতে প্রস্তুত হয়। এটা জানতে পেরে ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের প্রেক্ষাপটে তার সম্ভাব্য গ্রেফতারের বিষয়টি প্রকাশ করেন।

২১ মার্চ ও তার পরের কয়েকদিনেও অভিযোগ দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনা না ঘটায় এ বিষয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার বিষয়ে অধিকাংশ জুরি একমত না হতে পারায় মামলাটি ভেঙে পড়েছে (Fall apart) বলে ধারণা করেন। সেই ধারণা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। গত ৩০ মার্চ ডিএ’র কার্যালয় থেকে জানানো হয় গ্র্যান্ড জুরি ঘুষ প্রদানের ঘটনায় ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছে এবং এ কারণে ট্রাম্পের আইনজীবীর মাধ্যমে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে (৪ এপ্রিল) তাকে ডিএ’র কার্যালয়ে এসে আত্মসমর্পণ ও কোর্টে হাজির হতে বলা হয়।
এই অভিযুক্তির মাধ্যমে ট্রাম্প সংক্রান্ত সব জল্পনার অবসান হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আলভিন ব্রাগ একজন কট্টর ট্রাম্প বিরোধী হিসাবে পরিচিত। শোনা যায়, তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায় যে স্লোগানটিকে মুখ্য করেন, সেটি ছিল Vote for me, I will get Trump- যা কিনা এক সময়কার রুশ একনায়ক জোসেফ স্টালিনের বহুল পরিচিত একটি উক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্টালিন তার এক সহকর্মীকে বলেছিলেন Show me the man, I will find the Crimes অর্থাৎ তুমি শুধু লোকটার নাম বলো, তার কী অপরাধ সেটা আমি বের করে নেবো। কেউ কেউ ট্রাম্প বিষয়ে ডিএ’র তৎপরতাকে অনেকটা সেই রকম বলেই মনে করেন। আগামীতে নিউইয়র্কের গভর্নর হওয়ার জন্য পয়েন্ট বানানোর জন্য তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছেন, যাতে তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায় গর্বভরে বলতে পারেন, I am the man, who took Trump off।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের ও তাকে গ্রেফতারের তৎপরতাকে তার সমর্থক রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দ কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। তারা এটাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসামূলক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাদের ভাষায় এটা Political Persecution Ges Election Interference-এর নামান্তর। অপরদিকে ট্রাম্পবিরোধী মহল জানান No citizen is above law।

এই মামলার ট্রায়াল শেষ হতে হতে আগামী নির্বাচন চলে আসবে। এই সময় পর্যন্ত ট্রাম্প মামলার আসামী হিসেবে জামিনে থাকবেন বলে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্প হলেন একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি মামলার আসামী। এটা তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কতোটা প্রভাব ফেলবে, সেটা দেখার বিষয় হবে, যেটা দেখার জন্য আমাদেরকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে অনুষ্ঠেয় রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ট্রাম্পকে নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের সূত্রে দেশে অনাকাক্সিক্ষত নৈরাজ্য সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। জনৈক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, এর ফলে Trump Base will rally politically and possibly physically and the arrest will secure the nomination for Donald Trump।

অন্যতম মার্কিন শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক মনে করেন, ওIf he is arrested, he will be elected in a landslide victory।

অতি জনপ্রিয় মার্কিন চলচ্চিত্রের একটি সংলাপ উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি। সংলাপটি ছিল এ রকম- If you kill me, I will be more Powerful। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু হবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি না। বরং এ ঘটনার কারণে তার রাজনৈতিক কেরিয়ারের সমাপ্তির সম্ভাবনাই বেশি।

লেখক : কলামিস্ট।