ট্রাম্পের মিথ্যা ও আমাদের সত্য

শুভ কিবরিয়া

আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা কারণে খবরের শিরোনাম হন, হচ্ছেন। কেননা তিনি যা বলেন তা যতটা রাজসুলভ, তার চাইতে তার কথা ততটাই অরাজনৈতিক এবং অরাজসুলভ। তবুও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলে কথা গোটা পৃথিবীর নজর থাকে তার কথার প্রতি। কিন্তু ট্রাম্প হচ্ছেন সেই প্রেসিডেন্ট যার কথা সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন উঠছে। কথা উঠছে ট্রাম্প কতটা মিথ্যা বলেন তা নিয়েই। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম পরিসংখ্যান বের করছেন ট্রাম্পের মিথ্যা বলার পরিমাণের উপরেও। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার পরিসংখ্যান বলছে, ট্রাম্প গড়ে দিনে সাড়ে ছয়টি মিথ্যা বলেন। তাদের হিসাব বলছে, গত ৪৬৬ দিনে ট্রাম্প মোট ৩ হাজার একটি মিথ্যা বলেছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন তার মিথ্যা বলার গড় পরিমাণ হচ্ছে ৬ দশমিক ৫। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ১০০ দিনে তার মিথ্যা বলার হার ছিল দৈনিক ৪ দশমিক ৯। কিন্তু গত দুই মাসে এই হার প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ দিনে ৯টি মিথ্যা বলছেন ট্রাম্প। আবার এই পরিসংখ্যান বলছে, এমন অনেক মিথ্যা আছে, যা ট্রাম্প বারবার বলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাবে ১১৩টি মিথ্যা রয়েছে, যা ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন। দেখা যাচ্ছে শাসনকাল যত পুরনো হচ্ছে ট্রাম্পের মিথ্যা বলা ততই বাড়ছে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনের জনপ্রিয় ভাষ্যকার ক্রিস সিলিজার বলছেন, ডাইনে-বাঁয়ে মিথ্যা বলেন, এমন কোনো প্রেসিডেন্ট আমেরিকায় আগে কখনই ছিলেন না। জর্জ বুশ অথবা বারাক ওবামা দিনে কতবার মিথ্যা বলেছেন, তার কোনো হিসাব কেউ রাখেনি। তার কারণ, ট্রাম্পের মতো তারা কেউ-ই মিথ্যা বলতে ও সেই মিথ্যা বারবার আওড়াতে অভ্যস্ত ছিলেন না।
২. আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা কথা বলতে ভালোবাসেন। কথার রাজনীতি এখানে খুব পপুলার। যে নেতা কথা কম বলেন তিনি এখানকার রাজনীতিতে বেমানান। আমাদের জনসাধারণও কথা শুনতে পছন্দ করেন। আমাদের দেশের সরকারপ্রধান, রাজনৈতিক দলপ্রধানের কথা শুনতে আমরা হামলে পড়ি। হালে যখন প্রধানমন্ত্রী নানা দেশ ঘুরে এসে সেই সফরের বৃত্তান্ত দেশবাসীকে জানাতে প্রেস কনফারেন্স করেন সেটা বেশ উৎসাহের সৃষ্টি করে। প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্নের ধরন আর তার জবাব আজকাল যথেষ্ট উদ্দীপনাও তৈরি করে।
রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক অনেক বিষয়ে সরকারের মনোভাব কী, সেটা খুব পরিষ্কার হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স থেকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক খোলামেলাভাবেই তার মনোভাব প্রকাশ করেন এই প্রেস কনফারেন্সে। জাতি রাষ্ট্রের সংকট ও সমাধান বিষয়েও অনেক সত্য ইঙ্গিত মেলে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর তার মন্ত্রী ও দলের নেতাদের আর কোনো নতুন কথা থাকে না। দল ও সরকারের অনুগামীরা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স থেকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও পেয়ে যান আগামী দিনে তাদের কী বলতে হবে। ভাষার নৈপুণ্যে, শব্দ চয়নের কৃতিত্বে তখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সারকথা ও দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তিই কেবল ঘটতে থাকে।
আবার প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের যারা সমালোচক তারাও এরপর কথা বলতে থাকেন ওই প্রেস কনফারেন্সের আঙ্গিক ধরে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই অর্থে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্যও অসীম।
৩. প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ প্রেস কনফারেন্স হয়ে গেল গত ২ মে। সেদিনও তিনি নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে, খালেদা জিয়ার কারাদ- নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই তার মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি যেসব কথা বলেছেন তার কিছু কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে-
এক. ‘আমার এ কথাগুলো অনেকে পছন্দ করবেন না; কিন্তু যা বাস্তব, তাই বলছি। রাস্তায় চলার নিয়ম আছে, সেটা আমরা কতটা মানি? একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে আসছে, আমরা একটা হাত তুলে রাস্তায় নেমে গেলাম। যারা পথচারী, তাদেরও কিছু নিয়মনীতি জানা দরকার, মানা দরকার।’ (বণিক বার্তা, ০৩ মে ২০১৮)।
দুই. ‘আপনি বাসে চড়ে যাচ্ছেন, কেন আপনি হাত বাইরে রাখবেন? আপনারা (সাংবাদিক) যার হাত গেল, তার জন্য কান্নাকাটি করছেন, কিন্তু সে যে নিয়ম মানছে না, সে কথা তো বলছেন না।’ (বণিক বার্তা, ০৩ মে ২০১৮)।
তিন. ‘কাজেই তারা যখন দাবি করেছে, ঠিক আছে আমি বললাম, দাবি মেনে নিলাম, সব কোটা বন্ধ। এখন আবার নতুন করে কথা উঠবে কেন? হা-হুঁতাশ আসবে কেন? কাজেই যেটা করে দিয়েছি, করে দিয়েছি, আর কোটার দরকার নেই। কোনো জেলায় যদি না পায় আমাদের কিছু করার নাই। বরং তখন খুঁজে দেখব, কারণ আন্দোলনে যারা ছিল তাদের ছবি রেকর্ড করা আছে, তখন দেখা যাবে ওই জেলায় কারা কারা আন্দোলনে ছিল, সেটাও আমরা দেখব। তার পরও যদি এসে কান্নাকাটি করে, তখন আমাদের তেমন কিছু করার থাকবে না। পরিষ্কার কথা। (প্রথম আলো , ০৩ মে ২০১৮)।
চার. আমাদের প্রাচীন কবিরা বলে গেছেন, ‘যে কহে বিস্তর মিথ্যা কহে বিস্তর।’ আবার আমাদের প্রবাদে আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে’। তাই আমাদের সত্যভাষণও বিবেচনাসাপেক্ষ। কোনো পদে থেকে, কোনো বিষয়ে, আমরা কেমন করে, কী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলছি সেটাও বিবেচ্য। বড় পদে যারা থাকেন, তাদের কথা বেশি মানুষ শোনে। যারা ভরসার জায়গা তাদের বক্তব্য যদি মানুষকে আহত করে, তবে সেই কথা সত্য হলেও মানুষের জন্য সুখকর হয় না। প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পথচারীদের যে অসচেতনতার কথা বলেছেন, যে দায়িত্বহীনতার কথা বলেছেন তা হয়ত সত্য। কিন্তু সেটাই কি চূড়ান্ত সত্য সেটাই কি দুর্ঘটনার প্রধানতম কারণ? আর এই সত্যকথন দিয়ে কি রাজীবের হাত হারানোর মর্মান্তিক বেদনা লাঘব হয়? দুই বাসের দুষ্ট প্রতিযোগিতার খেসারত দিতে হয়েছে রাজীবকে। তার হাত হারানোর বীভৎস চিত্র সংবাদ মাধ্যমে আসার পরে, মানুষের মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কি রাষ্ট্রাচারসুলভ প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলার পরপর তার মন্ত্রীরা ইতোমধ্যেই মুখ খুলেছেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আর দেরি করেন নাই। দ্রুতই এক অনুষ্ঠানে বলেই ফেলেছেন, ‘সড়কপথে দুর্ঘটনা ঘটলে কেবল চালকদের দোষী বলা ঠিক নয়। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যাত্রীদেরও খামখেয়ালিপনা থাকে। দুর্ঘটনারোধে শুধু চালকদের সচেতন হলে চলবে না, যাত্রী ও পথচারীকেও সচেতন হতে হবে। কেউ কেউ রাস্তা পার হওয়ার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন, আবার কেউ কেউ জানালার বাইরে হাত রেখে গাড়িতে যাতায়াত করেন। এ কারণেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।’ (প্রথম আলো, ৫ মে ২০১৮)।
পাঁচ. প্রধানমন্ত্রীর এই কথার রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই পাহাড়ে ঘটছে একের পর এক হত্যাকা- ও খুন। রাঙ্গামাটির নানিয়ার চর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘এর পেছনে অনেক মতলবি মহল কাজ করছে। যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এই ষড়যন্ত্র করছে কেউ কেউ। তারা সোজা পথে কিছু করতে না পেরে বাঁকা পথ বেছে নিয়ে নানা ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। নির্বাচনের বছরে তারা ষড়যন্ত্র তৈরি করছে, অনেক কিছু করছে।’
অথচ এই অনুষ্ঠানেই তিনি জানিয়েছেন, ‘গত ২ মে ২০১৮ সকালেই শক্তিমান চাকমা আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলছিলেন তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। উপজেলা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছিলেন না। শক্তিমান চাকমা তার মেয়ের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে আমাকে বলেন, তার মেয়ে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে পড়েন। কিন্তু নানিয়ার চরে বসে তিনি মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। কলেজ বদলি করে মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় কি না দেখার অনুরোধ করেন।’
ছয়. সরকারের উন্নয়ন প্রচারণার মধ্যে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের সম্পদ কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে, এটা সত্য। বৈষম্য বহু পরিমাণ বেড়ে গেছে। অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক মানসিকতাও সবক্ষেত্রে বেড়ে যাচ্ছে।’
জনাব মেননের এই সত্যভাষণের মধ্যে হয়তো সব সত্য নেই। কিছুটা আড়াল আছে। কেন বৈষম্য কমছে না, কেন শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আওয়াজ দিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না? কেন, এত উন্নয়ন সত্ত্বেও জনমনে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা কমছে না, সেই কারণটা তিনি উচ্চারণে আগ্রহী নন।
রাজনীতিতে প্রকৃত গণতন্ত্রহীনতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, কি এইসব সামাজিক বৈকল্যের বড় কারণ? সেসব বিষয়ে রাশেদ খান মেনন নিরুত্তর।
যদিও ফিলিপাইনের ম্যানিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক সভা চলার সময় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মহাপরিচালক হুন কিম ইউএনবির করা এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কিভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে, সেটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এখন কোন সত্যকথন আমাদের জন্য তাহলে জরুরি
সাত. ট্রাম্প যা বলছেন, তার মধ্যে ‘মিথ্যা’ আবিষ্কৃত হচ্ছে, সে দেশে শক্তিমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকার কারণে। আমেরিকার শক্তিমান গণতন্ত্র সেখানে যে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি অর্জন করেছে তাই ট্রাম্পের মিথ্যাকে ধরবার সামর্থ্য পেয়েছে। আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে যে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের চর্চা করেছে তার ফলস্বরূপ সেখানকার মিডিয়া এই স্বাধীনতা চর্চার শক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। এখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নাই। ফলে এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব সামর্থ্য অর্জন করতে পারে নাই। এখানে স্বাধীন গণতন্ত্র যেহেতু রাজামুখীন, এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই রাজার মুখের দিকে চেয়ে চলতে অভ্যস্ত। শক্তিমান নির্ভীক, বস্তুনিষ্ঠ, জনস্বার্থহিতকর সাংবাদিকতার বদলে রাজাকে সন্তুষ্ট করার সাংবাদিকতা এখানে দিনকে দিন শক্তিমান হচ্ছে। আমাদের রাজারা তাই যে ‘সত্য’ বলছেন, তা কতটা জনহৃদয়কে সন্তুষ্ট করছে, কতটা ব্যথিত করছে, এই প্রশ্ন মিডিয়া তুলতে পারছে না। ফলে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা এখানে চলছেই। তাতে না জনকল্যাণ নিশ্চিত হচ্ছে, না জনহৃদয়ের তুষ্টি হচ্ছে। একটা রাজ-গোলকেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারা।