সিঙ্গাপুরে ট্রাম্প-কিমের ঐতিহাসিক বৈঠক

একে অপরকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করতেও ছাড়েননি। উভয়ের ভূমিকা পরমাণু যুদ্ধের হুমকিও তৈরি করেছিল। মুখোমুখি বসে তারা যে কথা বলতে পারেন সেটা কয়েক মাস আগেও কল্পনা করা যায়নি।
কিন্তু আজ মঙ্গলবার (১২ জুন) সিঙ্গাপুরে সেই অকল্পনীয় ব্যাপারটিই ঘটে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন।
স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায়) সিঙ্গাপুরের স্যান্টোসা দ্বীপের হোটেল দ্য ক্যাপেলোতে এই বৈঠক শুরু হয়েছে। সেখানে কেবল দোভাষী ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত থাকবেন না বলেও জানা গেছে।
এ বৈঠক কেবল কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি এবং মার্কিন প্রশাসনে স্বস্তি ফেরাবে তা নয় সারা বিশ্বে একটা শান্তির আবহ তৈরি করবে। ফলে বিশ্ব আজ তাকিয়ে থাকবে সিঙ্গাপুরের দিকে। বৈঠক নিয়ে আশা জেগেছে সত্যি, তবে ঝুঁকির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। খবর বিবিসি, সিএনএন ও রয়টার্সের।
অপেক্ষার অবসান : ট্রাম্প এবং কিম দুইজনই দেশের মধ্যে অজনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেই দুজন নেতার আজ সুযোগ ঘটেছে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার যা বিশ্ব কূটনীতিতে বড় ধরনের একটি পরিবতর্ন আনবে। দীর্ঘ ৭০ বছর পর কোনো ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন নেতার বৈঠক চলছে। তাদের মধ্যে আলোচনা কতক্ষণ হবে সেই বিষয়ে কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
তবে একটি সূত্র জানায়, দুই ঘণ্টাব্যাপী ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে বৈঠক হবে। পরে প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে মিলিত হবেন তারা। এ বৈঠক হতে পারে এক ঘণ্টা। এরপর দুই নেতা ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন। এদিকে জনসম্মুখে তেমন না এলেও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন পর্যটন স্থান গতকাল সোমবার (১১ জুন) পরিদর্শন করেছেন কিম।
আশার মধ্যেও ঝুঁকি : প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল টুইটার বার্তায় জানিয়েছেন, ভালোভাবেই সবকিছু এগুচ্ছে। সুন্দর কিছুই ঘটবে। এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি এক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারবেন বৈঠক সফল হবে কিনা। হোয়াইট হাউসও জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়া আশার চেয়ে বেশিই সাড়া দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে ইতিবাচক কিছু ঘটবে। প্রথম বৈঠক সফল হলে পরবর্তীতে আরো বৈঠক হবে। আর সফল না হলে কোনো বৈঠক হবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগামীকাল বুধবার (১৩ জুন) দেশে ফেরার কথা। আর কিম আজ (১২ জুন) বিকেলেই দেশে ফিরতে পারেন।
বৈঠকের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার যেমন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, তেমনি নিরাপত্তায় খরচ করতে হয়েছে সিঙ্গাপুর সরকারকেও। এজন্য সরকারের সমালোচনাও চলছে। মাত্র কয়েকদিনেই দেশটিকে ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে যা তাদের মোট নিরাপত্তা খরচের চেয়েও বেশি। তবে এত খরচের পরও বৈঠকটি করে আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্দেহ যেমন প্রবল, আশাবাদী হওয়ার কারণও দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা স্টাডিজের গবেষক এবং শিক্ষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, সিঙ্গাপুরের বৈঠকে ট্রাম্প এবং কিম সবাইকে চমকে দিতে পারেন। মাহমুদ আলী স্বীকার করেন, বিপদ অনেক রয়েছে। ব্যক্তিত্ব, অতীত, ক্ষমতায় আসার পটভূমি -এগুলোর বিবেচনায় ট্রাম্প এবং কিমের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দু’জন দুই জগতের মানুষ। কিম ক্ষমতায় এসেছেন পরিবারের পরম্পরায়, পড়াশোনা করেছেন সুইজারল্যান্ডে, বয়সে যুবক এবং একনায়ক। নিজের ক্ষমতার বিরুদ্ধে যখনই কেউ বিন্দুমাত্র চ্যালেঞ্জ করেছে, তাকে তিনি অবলীলায় সরিয়ে দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে, ট্রাম্প ব্যবসায়ী থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এমন একজন কেউ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হননি। তিনি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ অর্থাৎ তিনি কী বলবেন বা করবেন আগে থেকে ধারণা করা কঠিন। তবে দু’জনের বিষয়ে একটি মিল রয়েছে সেটি হলো নিজেদের প্রশাসনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রবল। ট্রাম্পের এই আচরণ কতটা হুমকি তৈরি করতে পারে শীর্ষ বৈঠকে? এ নিয়ে মাহমুদ আলী খুব বেশি শঙ্কিত নন। ব্যবসায়ী হিসেবে ট্রাম্প একটি বই লিখেছিলেন কীভাবে বৈরি প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তি করতে হয় তা নিয়ে। মনে হয় তার কৌশল হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মতৈক্যে পৌঁছানো।
মাহমুদ আলীর মতে, শুধুই এক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রশ্ন নয়, বরঞ্চ বর্তমানে আমেরিকার যে ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং সামরিক বাস্তবতা, সেটাই মীমাংসার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর একমাত্র পরাশক্তি নয়, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ক্ষমতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে, সুতরাং আমেরিকা এখন চাইছে বিশ্বের দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাদের লক্ষ্য যেন তারা হাসিল করতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার সাথে একটি চুক্তি নিয়ে আমেরিকানদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বলে মনে করেন মাহমুদ আলী। আমেরিকার প্রধান দাবি, উত্তর কোরিয়াকে পারমানবিক অস্ত্রসম্ভার, তৈরির সাজ-সরঞ্জাম, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। পক্ষান্তরে উত্তর কোরিয়ার দাবি-১৯৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধের যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তিতে রূপান্তর করতে হবে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার ঘাঁটি এবং অস্ত্রসম্ভার সরাতে হবে এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে হবে। এসব শর্তের সাথে উত্তর কোরিয়া দাবি করছে-হঠাৎ করে একটি বৈঠক থেকে এই নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, এটা ধীরে ধীরে করতে হবে।
মাহমুদ আলী জানান, মার্কিন কর্মকর্তাদের সামপ্রতিক কিছু কথাবার্তায় আঁচ করা যায় যে তারাও উত্তর কোরিয়ার অবস্থান স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। পর্যায়ক্রমে কয়েকবার বসে কথাবার্তা বলার বাস্তবতা তারা হয়তো মেনে নিচ্ছেন। তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র চীনও ওয়াশিংটন এবং পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। উত্তর কোরিয়ায় অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন নিয়ে চীন উদগ্রীব।
মাহমুদ আলী মনে করেন, আগামী দু’দিনে সিঙ্গাপুরে অবাক করার মত ঘটনা ঘটতেই পারে। ট্রাম্প এবং কিম মুখোমুখি বসলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা অনুমান করা কঠিন, কিন্তু আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে বৈঠকটি ফলপ্রসূ না হলে নতুন করে উত্তেজনাও তৈরি হতে পারে যা বিশ্বকে আরো হুমকির মুখে ফেলে দেবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইতিহাস ভালো নয় : উত্তর কোরিয়ার কাছে এমন ক্ষেপণাস্ত্র আছে যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের ৩ জন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং বরাক ওবামা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিল পেরি বলেছেন, তিনি বৈঠক নিয়ে আশাবাদী। এক মিনিটের মধ্যেই বোঝা যাবে বলে ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন তা সঠিক বলে মনে করেন পেরি।
তিনি ১৯৯০ সালে বিল ক্লিনটনের আমলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতার কাজটি করেছিলেন। বর্তমান কিম জং উনের পিতা কিম জং ইলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছাতে সমর্থ হন বিল ক্লিনটন। পরমাণু অস্ত্র প্রকল্প বাতিলের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া বিদেশ থেকে জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু জর্জ বুশ ক্ষমতায় এসে উত্তর কোরিয়া প্রতারণা করেছে উল্লেখ করে সেই সমঝোতা বাতিল করে দেন। এরপর বুশ চেষ্টা করলেও আর কোনো চুক্তি করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছিলেন ওবামাও।

আরো পড়ুন:

http://আলোচনা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো হয়েছে : ট্রাম্প