প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যখন ইসরাইলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরানোর ঘোষণা দিলেন, তার
নেপথ্যে অনেক কারণ ছিল। একটি কারণ হলো কয়েকদিন পরই মধ্যপ্রাচ্য সফরের কথা ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স-এর। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টানদের দুর্গতি তুলে ধরা। কিন্তু মজার বিষয় হলো, কপটিক খ্রিস্টান পোপসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে খ্রিস্টান নেতাই পেন্সের সঙ্গে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান। ট্রাম্প প্রশাসন না বুঝলেও, মধ্যপ্রাচ্যের এই খ্রিস্টান ধর্মনেতারা জানেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানরা অনেকদিন ধরে বসবাস করছে। রাজনীতি ও সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আধিপত্যের মধ্যেই তাদেরকে ভবিষ্যতে বসবাস করতে হবে।
যখনই মার্কিন নীতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি পক্ষপাতমূলক মনে করে সংখ্যাগুরুরা, তখনই মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে সহিষ্ণুতা কমে যায়।
অক্টোবরে ‘ইন ডিফেন্স অব ক্রিশ্চিয়ান্স’ নামে একটি সংগঠনের সংহতি সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পেন্স অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, যারা নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নির্যাতিত হন, তাদের রক্ষায় ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে। এটি অনেকের জন্যই দারুণ সংবাদ ছিল। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো হলো- আমেরিকার জন্য বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ বাড়ানোর সবচেয়ে সেরা ও সক্রিয় উপায়ের অন্যতম।
কিন্তু সমস্যা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন ও টেড ক্রুজের মতো রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যরা মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেখানকার খ্রিস্টান ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে চান। এই ধরনের ধর্মভিত্তিক পক্ষপাত মধ্যপ্রাচ্যের সংখ্যালঘুদের আরও ক্ষতি করে। প্রকৃতপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট ও ভুক্তভোগী হলো মুসলমানরা। অথচ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের আমন্ত্রণে আমি যখন ইরাকে গেলাম, সেখানে এক ভিন্ন চিত্র দেখলাম। বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে খ্রিস্টানরা। এর মাধ্যমে তারা তাদের উপাসনালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করছে। মুসলিম প্রতিবেশীদের চেয়ে এ খ্রিস্টানরা অনেক প্রাচুর্য সমেত এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের বিভাজন অসন্তোষের বীজ বপন করে।
শুধু ইরাকই নয়, অন্য সব মুসলিম দেশেও এই ধরনের ধারণা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে যে, আমেরিকা শুধু খ্রিস্টানদের কথা ভাবে। মুসলমানদের জীবন বা দুঃখ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
সম্প্রতি, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা এমন ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে। শুধু ইসরাইলের দাবির পক্ষে কথা বলা ও ধর্মভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে, ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমের ওপর ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দাবির প্রতি নিস্পৃহতা দেখিয়েছে। পূর্ব-জেরুজালেমে ফিলিস্তিনের জন্য মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের কথা বলতে পারতেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তিনি বলেননি।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনে অস্বস্তি আছে। পেন্স সম্প্রতি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমরা খ্রিস্টানরা ও অন্য যারা নির্যাতিত হচ্ছেন, তারা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করলেও পারতেন, যেখানে আমেরিকা তাদের সরাসরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে পেন্স স্পষ্ট করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুমুখী সহায়তা প্রদানে সম্পৃক্ত হবে না, যা মুসলমানরাও পেতে পারেন।
এই মার্কিন প্রশাসনের ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসআইডি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে যেসব অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা স্থগিত করে রেখেছে মার্কিন প্রশাসন। জাতিসংঘের এসব সংস্থা ইরাক সরকারের সঙ্গে কাজ করছে এমন সব ইস্যুতে, যা ইরাকিদের ভীষণ দরকার। এসবের ওপর মার্কিন নীতিও অনেকাংশে নির্ভরশীল। জাতিসংঘ ভুক্তভোগীদের প্রয়োজন ও ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তাদেরকে সহায়তা দেয়। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস’র নৃশংসতার শিকার মানুষদের এই সহায়তা ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভিকটিমদের ধর্মীয় পরিচয়কেই বড় করে দেখছে।
জাতিসংঘের সব প্রকল্পই কি কার্যকরী? না। কিন্তু কোনো উন্নয়ন সহায়তাই শতভাগ কার্যকরী হবে বা, সব উন্নয়ন সহায়তা কার্যকর হবে, তা নয়। এই ধরনের সহায়তাকে কার্যকারিতার ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয় না। কত মানুষের কাছে পৌঁছানো গেল, সেটি এখানে মানদণ্ড। ইরাকে এখন ১২০০টি প্রকল্প রয়েছে ইউএনডিপি’র। ইরাক সরকারের বেঁধে দেয়া অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ইউএনডিপি এসব প্রকল্প চালু করেছে। এসব প্রকল্পের সহায়তা ভোগ করছে বহুধাবিভক্ত ইরাকি সমাজ। কিন্তু শুধুমাত্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে সহায়তা করে, মুসলিমদের ছুড়ে দেয়ার ফল স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ- দু’য়ের জন্যই ক্ষতিকর।
(আটলান্টিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখকের ‘রিলিজিয়াস বায়াস ইজ ডিসটর্টিং আমেরিকান ফরেইন পলিসি’ শীর্ষক নিবন্ধের অনুবাদ।)