‘ঠিকানা’য় ঠিকানা

আব্দুল কাইউম আনোয়ার

এক.
দূর প্রবাসে আমরা বাংলাদেশিরা সর্বদা আমাদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের একটি উত্তম মাধ্যম খুঁজি। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সুবৃহৎ ও সুপ্রসিদ্ধ নগরী হলো নিউইয়র্ক। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে এই মহান নগরীতে পৌঁছে প্রথম ধাক্কায় সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। ১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে সোজা কুয়েত থেকে নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে এলাম। সেখান থেকে শাটল বাসে টাইম স্কয়ারে। আত্মীয়-স্বজনহীন নতুন গন্তব্যে হোটেলই ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয়ে একটি চিরকুটের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। কুয়েত এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে যেসব বন্ধু এসেছিলেন, তাদের একজনের দেওয়া সেই চিরকুটে ছিল একটি ফোন নাম্বার। হোটেলে চেক-ইন হওয়ার আগমুহূর্তে পকেট থেকে সেই ফোন নাম্বারটি বের করে ডায়াল করতেই বৃদ্ধ এক ভদ্রলোকের কণ্ঠ ভেসে এল কানে। ওনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলো। ওনার পরামর্শ অনুসারে ট্যাক্সি ডেকে ওজন পার্কে তাদের ডেরায় গিয়ে হাজির হই। প্রবাসে দেশের অনাত্মীয় আত্মীয়ের চেয়েও অধিক আপন। তারা একসঙ্গে বেশ কয়েকজন থাকেন একই ঘরে। তাদের সঙ্গ পেয়ে খুব অল্প সময়েই আমার একাকিত্ব, অসহায়ত্ব আটলান্টিক মহাসাগরে তলিয়ে গেল। আমি পরবাসে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি।
নিউইয়র্কে পৌঁছে প্রাথমিক পর্যায়ে আমার সন্দিহানতার পেছনে বড় দুটি কারণের প্রথমটি ছিল, পৌঁছার দ্বিতীয় দিন উষালগ্ন থেকে হাঁটুগাড়া বরফের স্তূপ আর দ্বিতীয়টি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার শীর্ষ খবর ‘অর্থনীতিতে মন্দার তীব্র কামড়’। যাহোক, এসেছি যখন কদিন থাকি, তারপর শেষ সিদ্ধান্ত নেব।
দুই.
মাস দুয়েক পর বরফ কেটে গেছে। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নেওয়ার জন্য দরখাস্ত জমা দিয়েছি। মন্দা কাটিয়ে অর্থনীতি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগবে। তবে আমেরিকানরা নিরাশ হয়নি। পত্র-পত্রিকা,

রেডিও-টেলিভিশনে প্রতিদিন অর্থনীতির নানা খবর ছাপা হচ্ছে। সতর্ক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। চাকরির বাজারের ওঠানামার খবরই আমার কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ সেই সংবাদই দেবে আমার অভিবাসনের স্থিতিশীলতা।
ইতিমধ্যে বছর কেটে গেছে। আস্তানা বদল করে চলে এসেছি কুইন্সে। নতুন বন্ধু জুটল- নাম মাহমুদ চৌধুরী। কয়েক দিনের মেলামেশায় উনি জেনে গেছেন আমি সাহিত্য পড়েছি, লেখালেখি পছন্দ করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৮৮ সাল ছাপা হয়ে বেরিয়েছে। এক মাস চলেও গেছে। দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছরের এই দ্বিতীয় মাসটি স্বাধীন বাংলাদেশে কী এক উন্মাদনা নিয়ে আসে বাংলাদেশিদের চিত্তে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যেন জাতিসত্তাকে উজ্জীবিত করে আত্মপ্রত্যয়ের বাসনায়। ১৯৪৮ সালে জন্মেছি বলে আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শরিক হওয়ার। কিন্তু সেই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। তাতে যোগ দিয়ে মনের সেই অতৃপ্তিকে অনেকটাই তৃপ্ত করেছিলাম। সে যাক, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতি স্মরণ করে পথযাত্রা ও শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। স্বদেশে এই প্রচলন ঐতিহাসিকভাবে ধরে রেখেছে লাখো কোটি বাংলাদেশি। আর এই প্রবাসে সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে মহান মর্যাদায় ভূষিত করার লক্ষ্যে একজন দেশপ্রেমিক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগটি হলো মাতৃভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’। এই সাপ্তাহিকী প্রকাশের দীর্ঘ তেত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে। যে মাতৃভাষাপ্রেমিক নিউইয়র্কবাসী বাংলাদেশিদের পরিচয়পত্র হিসেবে ‘ঠিকানা’ নাম দিয়ে এই সাপ্তাহিকীটি প্রকাশ করেছিলেন, সেই প্রকাশক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি জনাব এম এম শাহীন সেই মহতী উদ্যোগের জন্য সকলের প্রশংসার দাবিদার।
এই সাময়িকীতে এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি ছাড়াও সমাজের সার্বিক চালচিত্র স্পষ্ট ভাষায় সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ পায়। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে কতভাবে উপকৃত হন, বলে শেষ করার নয়। লেখকদের লেখালেখি ছাড়াও ব্যবসায়ীদের ব্যবসার প্রসারে এই সাপ্তাহিকী বিশাল ভূমিকা পালন করে আসছে। এমন কোনো বিষয় নেই, যা ঠিকানার পাতায় স্থান পায় না। সাহিত্যের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদও সুন্দর ও ঝকঝকে ছাপায় প্রকাশিত হচ্ছে।
তিন.
আমার বন্ধু, যিনি আমার কানে এই ‘ঠিকানা’ প্রকাশের খবর পৌঁছে দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করেছিলেন এবং একদিন সময় করে আমাকে ঠিকানার প্রথম দিককার ঠিকানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে পরিচয় হয়েছিল প্রকাশক জনাব শাহীন ও সম্পাদক জনাব মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। তাঁদেরই প্রেরণায় তখন থেকেই আমি লেখালেখির চর্চা শুরু করি। তবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে অনেক সময় তা বন্ধ রাখি। আমার লেখা প্রকাশের ব্যাপারে আমি সব সময় পত্রিকা সম্পাদকদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। এ ব্যাপারে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলতে পারি।
বিগত তেত্রিশ বছরে ‘ঠিকানা’ হয়ে উঠেছে সকল প্রবাসী বাংলাদেশির প্রাণের ঠিকানা। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির আলোকবর্তিকায় প্রজ্বলিত হোক ‘ঠিকানা’। আমরা যেন আমাদেরকে খুঁজে পাই ‘ঠিকানা’র ঠিকানায়।