শিতাংশু গুহ
ঠিকানার বর্ষপূর্তি, শুভেচ্ছা, স্বাগত। সাপ্তাহিক ঠিকানার এখন ভরা যৌবন। আমি যখন আমেরিকায় আসি, ঠিকানা তখন ভূমিষ্ঠ হয়েছে, দুধের শিশু। সেটা ১৯৯০। নিউইয়র্কে তখন শুধু ‘ঠিকানা’ ও ‘প্রবাসী’ এবং রঞ্জিতদা’র ‘সংবাদ বিচিত্রা’। এরপর আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে, নিউইয়র্কে সাপ্তাহিক পত্রিকা বাড়তে বাড়তে কুড়ি-বাইশে পৌঁছায়। এ সময়ে মহামারি ‘করোনা’র আঘাত, অনেক মানুষের মৃত্যু, গুটিকয় সাপ্তাহিক পত্রিকাও মুখ থুবড়ে পড়ে!
নিউইয়র্কে একসময় চালু হয় ‘ফ্রি’ পত্রিকা। একে একে সবগুলো পত্রিকা ‘ফ্রি’ হতে থাকে। ঠিকানা সটান দাঁড়িয়ে ছিল। পাঠক পয়সা দিয়ে তখনো ঠিকানা কিনত। সময় আসে, প্রশ্ন ওঠে, এতগুলো ফ্রি পত্রিকা থাকতে মানুষ পয়সা দিয়ে ঠিকানা কিনবে কেন? ঠিকানা তবু অনড়, একপর্যায়ে মূল্য কমায়। আরও পরে করোনা ও ফ্রি পত্রিকার ধাক্কায় ঠিকানাও ফ্রি হয়! নিউইয়র্কে এখন সকল সাপ্তাহিক ফ্রি, ঠিকানা সর্বশেষ সবার সঙ্গে একই কাতারে শামিল হয়।
বাঙালি নাকি ফ্রি পেলে ‘আলকাতরা’ও খায়, পত্রিকার জন্য এ কথা সত্য নয়! ‘মাগনা’ দেওয়া সত্ত্বেও মানুষ পত্রিকা তেমন হাতে নেয় না। পত্রিকার কাটতি কমেছে। ঠিকানার চাহিদা হয়তো এখনো আছে, তবে সার্বিকভাবে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিকগুলোর অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয়! সৈয়দ মুজতবা আলী বাঙালির বইপড়া নিয়ে যথেষ্ট ব্যঙ্গ করেছেন, ডিজিটাল যুগে তিনি থাকলে কী বলতেন, কে জানে? যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পত্রিকাগুলোও ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে।
প্রায় সব সাপ্তাহিক এখন ডিজিটাল। এ দেশে ‘পেপারলেস’ হওয়ার বিজ্ঞাপন প্রচুর, হার্ড কপির চাইতে সফট কপির কদর বেশি। পত্রিকাগুলো তাই পেপারলেস হচ্ছে। ঠিকানা ও অন্য কয়েকটি পত্রিকা ডিজিটাল হলেও প্রিন্ট কপি প্রকাশ পাচ্ছে। পত্রিকা ছাপতে না হলে প্রিন্টিং কস্ট, ডেলিভারি খরচ বাঁচে। মানুষ এখন পত্রিকা দেখে, খুব একটা পড়ে না, হাতে নেওয়াটা যেন কষ্টকর। হয়তো তাই একদিন প্রিন্ট কপি আর থাকবে না। তবে জ্যাকসন হাইটসে ‘চুটকি’ আছে, ‘বৃষ্টির দিনে সাপ্তাহিক পত্রিকার কাটতি বাড়ে!’
একটা সময় ছিল ঠিকানা কমিউনিটিকে লিড দিত, এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে, যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গঠিত হয়েছে ‘এডিটরস কাউন্সিল’। এটি ব্যবসা উন্নয়নে যথেষ্ট উৎসাহী, মিডিয়ার সম্মান ও মানোন্নয়নে ততটা যত্নশীল নয়। একটি দৃষ্টান্ত দিই, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে এলে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করেন, মিশন ঠিক করেন কারা সেখানে যাবেন, কোন সাংবাদিক আগে প্রশ্ন করবেন, এমনকি সামনের সারিতে কোন মিডিয়া বসবে!
আমেরিকায় গত নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের মুখ্য দুটি কারণ হচ্ছে, করোনা এবং মিডিয়া। মিডিয়ার ভূমিকা সবাই অবগত। সেই আমেরিকায় মিশনের খবরদারিতে স্থানীয় মিডিয়া সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। কর্মকর্তারা অখুশি হন এমন প্রশ্ন করেন না! এতে প্রধানমন্ত্রীকেও খাটো করা হয়, তিনি হয়তো এসব জানেন না। চারবারের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম, তবু আমলাদের কথামতো সাংবাদিকেরা ‘সুবোধ বালক’ হয়ে যান?
২০২২-এ জাতিসংঘ থেকে ফিরে গিয়ে ঢাকার সংবাদ সম্মেলন অনেকেই দেখেছেন! দেশে না হয় চাওয়া-পাওয়ার বিষয় আছে; ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন আছে; আমেরিকায় তো এসবের বালাই নেই, তাহলে? কেউ কেউ বলেন, দেশে গেলে সমস্যা হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে, কোন সাংবাদিক দেশে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন? ইউটিউবে দু-একজন অনর্গল মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন, তাদের কথা ভিন্ন, ওটি প্রোপাগান্ডা, সাংবাদিকতা নয়।
মিডিয়াকে বলা হয়, ‘চতুর্থ স্তম্ভ’। মিডিয়ার গঠনমূলক সমালোচনা সরকারকে সঠিক রাস্তায় চলতে সহায়তা করে থাকে। দেশে বা প্রবাসে মিডিয়ার এই ভূমিকা দেখা যায় না। আশির দশকে দৈনিক ইত্তেফাক না দেখলে আমাদের পত্রিকা পড়া শেষ হতো না; একসময় ঠিকানাও তা-ই ছিল। দেশে সাংবাদিকতার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা কে জানে? একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, পুরো বাংলাদেশি মিডিয়া কেউ আগাম কোনো খবরই দিতে পারল না? ঠিকানা এর হৃত গৌরব ফিরে পাক।
আমি ঠিকানায় লিখি সিকি শতাব্দীর বেশি। অনেকে আমাকে সমালোচনা করেছেন, বারণ করেছেন, আমি শুনিনি। ঠিকানা অনেকের অপছন্দ, সেটা হতেই পারে, কিন্তু আমি ঠিকানায় লিখি, কারণ এই পত্রিকা কখনো আমার মতামত পাল্টে দিয়ে তাদের পছন্দসই করেনি, অর্থাৎ আমি যা লিখেছি, তা-ই হুবহু ছেপেছে। আমার বক্তব্য প্রায়ই ঠিকানার সম্পাদকীয় নীতিমালার বাইরে গেছে, তবু তারা একটি দাঁড়িকমা বদল করেনি, সুতরাং? একই কারণে আমি লাইভ অনুষ্ঠান পছন্দ করি।
ঠিকানার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। ঠিকানা পাঠকপ্রিয়তার পক্ষে এর মতাদর্শ পাল্টায়নি, এ জন্য ঠিকানা টিকে আছে। ২০০১ সালের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলাম। তখন আমি অনেকের কাছে ‘হিরো’ ছিলাম। আজও আমি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমানভাবে সোচ্চার, কিন্তু এখন আমি তাদের কাছে ‘জিরো’। আমি কিন্তু আমার অবস্থান পাল্টাইনি, ঠিকানাও গাল-মন্দ সহ্য করে ‘অনড়’ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো মানুষ এ জন্য ঠিকানাকে ভালোবাসে। হয়তো এ জন্য ঠিকানা পাঠকপ্রিয়। হয়তো এ কারণে ঠিকানা টিকে থাকবে। থাকুক।
-নিউইয়র্ক। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩