ঠিকানার জন্মদিনে আমার অভিনন্দন—-সৈয়দ জিয়াউর রহমান

আজ থেকে এক চল্লিশ বছর আগের কথা। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ভয়েস অব আমেরিকা থেকে আমাকে নিউইয়র্কে পাঠানো হয়েছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের খবরাখবর পাঠানোর জন্য। সে সফরে আমার আরো একটি দায়িত্ব ছিল নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশিদের খুঁজে বের করে আমেরিকায় তাদের জীবনযাপনের বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের। কিন্তু নিউইয়র্কের কোথাও কোনো বাংলাদেশির সন্ধান পাচ্ছিলাম না। সে সময় আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন মনোজ ভৌমিক নামে পশ্চিমবঙ্গের এক সুদর্শন তরুণ। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার হোটেলেই।

মনোজ ব্রডওয়ের নাটকের অভিনেতা ছিলেন। তিনি তিন-চারজন বাংলাদেশির সন্ধান করে তাদের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। মনোজ একজন ভালো লেখকও ছিলেন। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতো। একদিন হোটেলে আমার রুমে বসে চা খেতে খেতে মনোজ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি নিউইয়র্ক শহরে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের। তারা বলেছিলেন, এতে আর্থিক লোকসানের আশঙ্কাই বেশি এবং লাভের কোনো সম্ভাবনাই নেই। মনোজ আমাকে বলেছিলেন, ‘দাদা, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখলাম এই নিউইয়র্ক শহরে একদিন বাংলা পত্রিকা বেরোবে এবং তা বের করবেন বাংলাদেশিরাই।’
মনোজ এর কয়েক মাস পরই নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটন এলাকায় গাড়ি চালাতে চালাতে অকস্মাৎ হৃদ্্রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান।
আজ পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই মনোজ ভৌমিকের ভবিষ্যদ্বাণীই সঠিক হয়েছে। মনোজ দেখে যেতে পারেননি নিউইয়র্ক শহরে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করেন বাংলাদেশিরাই! প্রথম পত্রিকা ছিল সম্ভবত ‘সাপ্তাহিক প্রবাসী’। তারপর প্রকাশিত হয় আরো বেশ কয়েকটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর মধ্যে ১৯৯০-এর একুশে ফেব্রæয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’।
বাংলা পত্রপত্রিকার ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, সাময়িক পত্রিকার আয়ুষ্কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বে সর্বত্রই বাংলা পত্রপত্রিকার এই ভবিষ্যৎ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে সুদীর্ঘকাল ধরে অনেক ভালো ভালো বাংলা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এক্ষেত্রে আমার নিজের অভিজ্ঞতাও দুঃখজনক। ১৯৬০ সালে ঢাকায় ‘নোতুন খবর’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন তখনকার দিনের বিশিষ্ট সাংবাদিক কে এম এম আবদুল কাদের। তিনি ছিলেন দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের এবং বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম বার্তা সম্পাদক। আমাকে তিনি নিয়োগ করেছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক। আমরা অনেক খেটেখুটে সাপ্তাহিক ‘নোতুন খবর’-কে দাঁড় করিয়েছিলাম এবং অল্প দিনের মধ্যেই এ পত্রিকা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। কিন্তু এর কিছুকাল পর জেনারেল আইয়ুব খান পত্রিকাটির প্রকাশককে কারাবন্দী করেন। ফলে সাপ্তাহিক নোতুন খবরের অপমৃত্যু ঘটে।

নিউইয়র্কেও প্রথম যে কয়টি বাংলা পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়, তার প্রায় অধিকাংশই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু সাপ্তাহিক ঠিকানা বাংলা সাময়িক পত্রিকার আয়ুর সীমাবদ্ধতা অতিক্রমে সক্ষম হয়েছে। ঠিকানা এখন ২৯ বছরে পদার্পণ করল। পত্রিকাটির এই সাফল্যের বেশ কিছু কারণ সুস্পষ্ট। প্রথমত আমি মনে করি, পত্রিকাটির সম্পাদনার কাজে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা রাজনীতি করেন না। অর্থাৎ পত্রিকা পরিচালনায় তারা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন না। তারা সঠিক অর্থেই সাংবাদিকতা করেন।
ঠিকানায় বাংলাদেশ ও আমেরিকার রাজনৈতিক খবরাখবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সঠিক ও পুরোপুরি নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। ঠিকানার পাঠকেরা আমেরিকা ও স্বদেশের যেসব সংবাদ জানার প্রত্যাশা করেন, তার সবই থাকে এ পত্রিকায়। সেই সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে থাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু নিবন্ধ। এগুলোর সবই পাঠকনন্দিত।
তা ছাড়া দীর্ঘ এক শ পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড সাইজের এ পত্রিকা প্রতি সপ্তাহেই নির্ধারিত সময়ে পাঠকের হাতে পৌঁছায় এবং এখন পর্যন্ত এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঠিকানার পাঠক এখন অগণিত। আমেরিকার সুদূর আরিজোনা ও নিউ মেক্সিকো রাজ্যের কয়েকটি প্রত্যন্ত শহরে থাকেন আমার কিছু আত্মীয়-পরিজন ও পরিচিত কয়েকজন। তারা নিয়মিত ঠিকানা পড়েন এবং তাদের অনেকেই এ পত্রিকার গ্রাহক। ঠিকানায় আমার লেখা প্রকাশিত হলে তারা আমাকে টেলিফোন করেন। আমি শুনেছি, গোটা আমেরিকার প্রায় সর্বত্র, প্রতিবেশী কানাডার বিভিন্ন শহরে এবং মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ে ঠিকানার পাঠক রয়েছে।
একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার এই জয়যাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য। আমার আশা, ‘ঠিকানা’র সাফল্য সুদূরপ্রসারী এবং আরো পাঠকনন্দিত হবে। সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’র জন্মদিনে আমার অভিনন্দন।
লেখক : সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র এডিটর।