বেনজির শিকদার :
পত্র থেকেই পত্রিকা। সে কারণেই পত্রিকা পাঠকের সঙ্গে একধরনের পত্র-যোগাযোগও স্থাপন করে থাকে। পত্রিকা যেমন দৈনন্দিন সংবাদ উপস্থাপন করে, তেমনি সমকালীন পাঠককে করে তোলে আরও বেশি সচেতন।
পত্রিকা আসে, পত্রিকা হারিয়ে যায়। কিছু পত্রিকা নিজস্ব মতাদর্শ ও প্রকাশসৌন্দর্যের কল্যাণে পাঠকের মনে স্থায়ীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়! চলমান দৌরাত্ম্যে তেমনি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ঠিকানা’ একটি সময়জয়ী পত্রিকার নাম।
‘ঠিকানা’-নামটার মধ্যেই রয়েছে এক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের গন্ধ! যেখানে একজন পাঠক অনায়াসে খুঁজে পায় তার মুক্তচিন্তার রোদেলা স্পর্শ, খুঁজে পায় মানসিক বোধ ও সংবাদভিত্তিক চাহিদার রসদটুকুও।
খুব ছোটবেলা থেকেই আমি পড়তে ভালোবাসি! বড় হতে হতে পত্রিকা পড়ার আনন্দ ও সুখটুকু ধরা দেয় ভিন্ন এক প্রিয় আকর্ষণ হয়ে। মাথায় ভর করে পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন রকম সাহিত্য-সাময়িকী সংগ্রহের নেশা। কালপরিক্রমায় সেই সব পত্রিকা-বুঁদ সময় দূরে চলে গেছে। অনেক পত্রিকাই কাগজ থেকে বিযুক্ত হয়ে এখন ওয়েবপোর্টাল!
মানুষের হাতে হাতে যখন শুভ্র স্ক্রিনের রঙিন ঝলক, তখন কাগুজে পত্রিকার টিকে থাকা বেশ কঠিনই। এই কঠিন সময় পেরিয়ে ‘ঠিকানা’ তার কাক্সিক্ষত ঠিকানার দিকে এগিয়ে চলেছে। সুদীর্ঘ ৩৩ বছর যাবৎ নিজস্ব মতাদর্শ ও গতির জৌলুশে এগিয়ে যাচ্ছে সদর্পে!
নিউইয়র্কের প্রবাসজীবনে বসে যখন প্রথমবারের মতো ঠিকানা পত্রিকা হাতে পাই, ভালো লাগার প্রাবল্যে সেদিন অনুভব করেছিলাম নিজের ভাষার তুমুল মাধুর্যটুকু। আমরা যারা প্রবাসে থাকি, ফেলে আসা দেশের চেয়েও বেশি মিস করি মাতৃভাষাকে। মন খুলে দুটো কথা বলার জন্য আশ্রয় খুঁজি আরেকজন বাঙালির কাছে। এই যে ভাষার ভার বহন করে আমরা চলেছি সামনের দিকে, এই ভিন ভাষার দেশে বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকার একটা পৃষ্ঠা একজন বাঙালির কাছে একজন ভাষামুখর মানুষের মতোই মূল্যবান।
বিশেষ করে, যারা বয়সী-বাঙালি, তাদের অবসরের মুহূর্তগুলো বাংলা পত্রিকার পৃষ্ঠায় বিচরণ করে প্রিয় সঙ্গীর মতো। গল্পের ছলে শোনা যায়, দেশ থেকে নতুন আসা মানুষগুলোর পাশে বাংলা পত্রিকা অনেকটা উপদেষ্টার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঘরে বসে যেমন বৈশ্বিক সংবাদগুলো পেতে পারেন, তেমনি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পড়ে, সেই সব সংবাদ নিয়ে মেতে উঠতে সক্ষম হন নানা রকম আলোচনা ও পর্যালোচনায়। অন্যদিকে যারা সৃজনশীল সাহিত্যসংশ্লিষ্ট মানুষ, তারা পত্রিকার পাতায় খুঁজে ফেরেন সাহিত্যের শিল্পরস।
আমরা যারা প্রবাসে বসে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করছি, আর ‘ঠিকানা’র ঠিকানাকে আশ্রয় করে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে লেখাগুলো; সেই আমাদের জন্য প্রবাসে বসে বাংলা পত্রিকায় নিজের লেখার মুদ্রণরূপ দেখার আনন্দটুকু অন্য রকম এক বিস্ময় নিয়ে ধরা দেয়! মন বলে, বিভুঁইয়ে স্বদেশপ্রাণের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে এই যে মাধ্যম, এর প্রচ্ছন্ন অথচ স্থায়ী সুখ অনেক; এ আনন্দ আত্মিক মিলনেরই নামান্তর।
কোনো কোনো পত্রিকায় স্থান সংকুলানের সীমাবদ্ধতায় লাইন মেপে লেখা পাঠাতে বলা হলেও ‘ঠিকানা’ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ঠিকানায় লেখকের স্বাধীনতায় নেই কোনো সংকুচিত প্রান্তদেশ বা সংক্ষেপ সমীকরণ। হোক অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক, আমরা যেমন আমাদের লেখাগুলোকে যত্নে লালন করি, ঠিকানা পত্রিকাও তেমনি আমাদের লেখাগুলোকে সযত্নে প্রকাশ করে বাংলাপ্রেমী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।
পত্রিকা শুধু সংবাদ প্রকাশের মাধ্যম নয়, একটা আদর্শ পত্রিকা মূলত সংযোগ স্থাপনের কাজটাই করে। গ্রাম থেকে গ্রাম, শহর থেকে শহর, দেশ থেকে মহাদেশের আমূল ব্যবধান ঘোচানোর পাশাপাশি ব্যক্তির বাহন হয়ে, মনের শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাণিজ্যিক প্রসারতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যাতে সময়ের গতি সম্বন্ধে আরও বেশি সচেতন হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য কাক্সিক্ষত উপকারভোগীর কাছে বিশ্বায়নের প্রায় সবকিছুই পৌঁছে দেওয়ার জন্য থাকে এর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
বাঙালির অসীম ঐশ্বর্যের তত্ত্ব ও তথ্য মমত্ব নিয়ে নিউইয়র্কে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে আছে, ‘ঠিকানা’ পত্রিকাটি। সময়ের আধুনিক অর্থ ও ব্যঞ্জনা বহন করে, যুগের আলোতে ঠিকানা এগিয়ে চলুক তার কাক্সিক্ষত মঙ্গল-ঠিকানায়। ঠিকানার সহযাত্রী হতে পেরে আমি আনন্দিত!
কোথায় যে ঠিক কার ঠিকানা-
যাত্রী সবাই পথে; ঠিকানা যাক মূল ঠিকানায় চড়ে সময়রথে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।