ঠিকানার ৩৪ বছরে পদার্পণের ধারাবাহিকতা মসৃণ বলা যাবে না

এস এম মোজাম্মেল হক :

সংবাদপত্র অন্য আর দশটা শিল্পের মতো শিল্প নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। একটি পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে পণ্য উৎপাদনের যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, সংবাদপত্রের চ্যালেঞ্জ তা থেকে অনেক বেশি ও ভিন্ন। একটি সংখ্যা প্রকাশের পর পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশ করা যাবে কি না, এটাই তার মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ, অন্য শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার পর নিরলসভাবে পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠান ও মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে কিন্তু সংবাদপত্র সে রকম নিরলসভাবে উৎপাদনশীল কোনো শিল্প নয়। সংবাদপত্রের টিকে থাকা নির্ভর করে প্রতিনিয়ত এর রসদের জোগান এবং সমাজের প্রতিটা স্তরে গ্রহণযোগ্য ভূমিকার ওপর। সংবাদপত্র অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো একক ও স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাপূর্ণ একটি সম্মিলিত রূপ। সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতা অন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভিন্ন ও অনেক বেশি।

সংবাদপত্রের ভোক্তা শুধু পাঠক নয় এবং এটি অন্যান্য শিল্পের মতো একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও নয়। বরং এটি একটি সামাজিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যার সংশ্লিষ্টতা ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজের প্রতিটা সদস্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি সংখ্যা প্রকাশের পর পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশের জন্য নতুন করে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট সবার নিকট গ্রহণযোগ্য উপায়ে পরিবেশন করা খুবই দুরূহ কাজ। যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, তাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। সংবাদপত্রের গুণমান ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য বিষয়-বৈচিত্র্যসহ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশনা সংবাদমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যার ওপর পাঠকপ্রিয়তা অনেকাংশেই নির্ভরশীল। অন্যান্য পণ্যের যেমন ব্যবহার পর্যন্ত প্রয়োজন সীমিত, সংবাদপত্রের তা নয় বরং কোনো কোনো সংবাদের সংবাদমূল্য ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ও সমাজের দর্পণ। সংবাদপত্র নিজের যোগ্যতাবলেই সমাজে তার এ অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রেখে আসছে, যার ব্যাখ্যা আর নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

উপরিল্লিখিত চ্যালেঞ্জের বাইরেও কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে, যা একান্ত সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট লোকদের বাইরে অন্যের জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে কালেভদ্রে সংশ্লিষ্টদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট টানাপোড়েনের ফলে কিছু তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ পায়, যা অনভিপ্রেত। দীর্ঘদিন ঘর-সংসার করার পর অনিবার্য কারণে ছাড়াছাড়ি হলে তখন মধুর সময়ের কিছু তিক্ত কথা উভয়ের নিকট থেকেই প্রকাশ পায়, যা তাদের সম্মানের জন্য হানিকর এবং ওইসব প্যাঁচাল অন্যদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। দীর্ঘ ২২ বছর একত্রে থাকার পর উভয়ের নিকট থেকে একে অপরের সমালোচনা নিতান্তই দুঃখজনক। তা সত্ত্বেও প্রথম যিনি মুখ খোলেন এবং অনাকাক্সিক্ষত শব্দচয়ন করেন, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। যদি সত্যিই হয়, তবে দীর্ঘদিন যিনি সত্য চেপে রেখেছেন, দায় তারই। সংবাদপত্রশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়, সন্দেহ নেই। প্রতিটা সংবাদপত্রেরই সম্পাদকীয় নীতিমালা থাকে, যারা এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, নীতিমালা মেনেই তাদের কাজ করতে হয়। সুতরাং বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে কটূক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সৌজন্যবোধের স্বার্থে উভয় পক্ষই বিষয়টি সহজভাবে নিষ্পন্ন করবেন বলে পাঠক ও পর্যবেক্ষক মহল আশা পোষণ করেন।

পাঠকের চাহিদানির্ভর বিষয়ভিত্তিক সংবাদপত্র যেমন আছে, তেমনি সকল শ্রেণি-পেশার উপযোগী কমন সংবাদপত্রও আছে, যা একটি আদর্শ সমাজের সর্বস্তরের চাহিদা পূরণ করে থাকে। একটি সাধারণ সংবাদপত্রের বিষয়-বৈচিত্র্য নির্ভর করে সংবাদপত্রের আওতাভুক্ত জনগোষ্ঠীর চাহিদা, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ও সমাজের সংগতি-অসংগতির চিত্র তুলে ধরার ওপর, যার মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। কিছু সংবাদপত্রের আওতা ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও অনেক সংবাদপত্রের প্রভাব বিশ্বব্যাপী। সংবাদের আওতা ও পরিবেশনের গুরুত্বের ওপর যা নির্ভরশীল। তবে সংবাদপত্রের ভাষাও এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা বহন করে। সংবাদের বিষয় ও ভাষা পাঠক ও সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অনুকূল হলে তা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে নিউইয়র্কে বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার বিষয়টি আমলে নেওয়া যেতে পারে। নিউইয়র্ক শহরে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য নিজ ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ এবং বিনামূল্যে পাঠকদের নাগালে সরবরাহ করা দুরূহ কাজ হলেও নতুন-পুরোনো বহুসংখ্যক বাংলা সংবাদপত্র এই কঠিন কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত রাখছে। এর মধ্যে ঠিকানা পত্রিকার ৩৩ বছর পেরিয়ে ৩৪ বছরে পদার্পণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এর পথচলা যে মসৃণ ছিল, তা নয়, তবু পত্রিকাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার গৌরব বহন করে।

নিউইয়র্কে বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে নবীন-প্রবীণদের বয়স বিবেচনা করলে সাপ্তাহিক ঠিকানা প্রকাশনার বয়স বিবেচনায় অতি পুরোনো একটি পত্রিকা। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে যার আত্মপ্রকাশ একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়। নিয়মিত ৭২ পৃষ্ঠা-সংবলিত ইংরেজিপ্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে একটি বাংলা পত্রিকার ৩৩ বছর পেরিয়ে ৩৪ বছরে পদার্পণ খুব সহজ কথা নয়। ঠিকানা পত্রিকার বিষয়-বৈচিত্র্য, সংবাদ ও অন্যান্য বিভাগের লেখার মান ও বিন্যাস, ছাপার মান ও তৎসংশ্লিষ্ট ফটোগ্রাফ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণে এটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য একটি পত্রিকা হিসেবে অনন্য বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে সত্তরের দশকে যতদূর স্মরণে আসে কিষাণ পত্রিকায় মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর চাকরিতে যোগদানের কারণে নিয়মিত সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করা সম্ভব হয়নি।

তবে চাকরির সুবাদে যেসব জেলায় অবস্থান করেছি, জাতীয় পত্রিকাসহ সেখানকার স্থানীয় পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেছি। এ ছাড়া একটি জেলা শহর থেকে প্রকাশিত চারটি সাপ্তাহিক পত্রিকার দুটির সাহিত্য পাতা সম্পাদনা ও অন্য দুটিতে নিয়মিত সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখা প্রকাশ অব্যাহত থাকে। একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদকীয় লেখা ছিল প্রায় নিয়মিত, যার কিছু সম্পাদকীয় বিশিষ্টজনদের বিবেচনায় ওই পত্রিকার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পাদকীয়ের মর্যাদা লাভ করে। সাধারণ পাঠকেরা না জানলেও পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ লোকজন ঠিকই জানতেন। বিষয়টি প্রচারের জন্য নয়, বরং পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ শীর্ষক আলোচনা পর্বটি সামনে আসার পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতালব্ধ কথাগুলো উল্লেখ করা হলো মাত্র। এলজিইডির রংপুর জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিকে উন্নয়ন-বিষয়ক খবর পরিবেশন ছিল নিয়মিত। নিউইয়র্কে আসার পর সংগত কারণেই লেখালেখির ব্যাপারে কিছুটা ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করি। এখান থেকে প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের লেখার মান ও সম্পাদকীয় নীতি-আদর্শ অনুধাবনের চেষ্টা করি। অতঃপর দুই বছর থেকে লেখা প্রকাশে আগ্রহী হই। বর্তমানে পছন্দের চার-পাঁচটি পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে, এর মধ্যে ঠিকানাই অগ্রগণ্য।

বিজ্ঞাপন প্রকাশ পত্রিকার আয়ের একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হলেও পত্রিকায় প্রকাশিত সকল বিষয়েরই একটি সংবাদমূল্য রয়েছে, এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। বিজ্ঞাপন যারা দেন এবং বিজ্ঞাপন থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্যটি জেনে যারা উপকৃত হন, উভয়ের নিকট এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও রক্ষা করার মতো অনেক গোপনীয় খবর, যা সরকারের কূটনীতিক ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক সরকারের গোচরীভূত করার কথা অথচ কোনো কারণে সরকার তা পেতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এরূপ অনেক গোপনীয় খবরও অনুসন্ধানী সংবাদিকতার মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ পাওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট দেশ ও জনগণ অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা থেকে রেহাই পেয়ে যায়। এরূপ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্ট বিভাগের সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে বিষয়টি নির্ভর করে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের গ্রহণ-বর্জনের মানসিকতার ওপর। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় জীবনে ছোট-বড় অনেক আনন্দ উৎসবের উপলক্ষ থাকে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এরূপ অনেক উৎসব আয়োজন করে থাকে। সংবাদপত্রশিল্প প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা get-together হিসেবে তাদের অনুষ্ঠানের যে আয়োজন করে, সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার অনুরূপ একটি আনন্দ আয়োজন ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জুনে get-together dinner হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। ঠিকানায় কবি, লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক হিসেবে যারা সারা বছর নিঃস্বার্থভাবে বিভিন্ন বিষয়ে লিখে পত্রিকার কলেবর ও পাঠকদের মনোজগৎ সমৃদ্ধ করে থাকেন, বার্ষিক এরূপ অনুষ্ঠানে পত্রিকার পক্ষ থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা প্রদান করে তাদের উৎসাহিত ও সম্মানিত করা যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে। সকল বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে পত্রিকাটির মসৃণ পথচলা ও প্রকাশনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকাসহ সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।