হারুন-অর-রশিদ : দেশের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় টাকার বিপরীতে দাম বাড়ছে হু হু করে। সর্বশেষ কার্যদিবস গত ৩ মে, বৃহস্পতিবার, ব্যাংকে নগদ ডলার সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ২ টাকা। আর এক বছরে ৪ টাকা। সব মিলে দামটা ছুটছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্রাতিরিক্তি আমদানি ব্যয়, পাচার, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহের নিম্নগতিকে ডলার সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। যে হারে খরচ হচ্ছে, আয় আসছে না সে হারে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি থমকে গিয়ে উল্টো নিম্নমুখী।
গত মে, সোমবার, এবি ব্যাংকে নগদ ডলারের বিনিময়ে দিতে হয়েছে ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা। তবে গত ৮ মে, মঙ্গলবার, দাম কমিয়ে ব্যাংকটি ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, শাহজালাল ইসলামী ও ইসলামী ব্যাংক দাম তুলেছে ৮৬ টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক দাম আরো বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ১৫ পয়সায় বিক্রি করেছে। অন্য ব্যাংকগুলোর দাম ছিলো ৮৪ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে। গত বছরের এই দিনে ব্যাংকভেদে নগদ ডলারের দাম ছিল ৮২ থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। দুই সপ্তাহ আগেও ব্যাংকে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ৪৫ পয়সা দরে বিক্রি হয়। আর খোলা বাজারে ছিল ৮৫ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল তারা প্রতিডলার বিক্রি করেছে ৮০ টাকা ২৩ পয়সা দরে। এখন করছে ৮৩ টাকা ১০ পয়সায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়ার পর আমদানি বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ছিলো বেশ কিছু দিন। কয়েকদিনের ব্যবধানে কয়েকটি ব্যাংক এক্ষেত্রেও মূল্য বাড়িয়ে ৮৩ টাকা ৬৫ পয়সা করেছে। তবে গত বছর ছিল ৮২ থেকে ৮৩ টাকা ১০ পয়সা পর্যন্ত।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। প্রচুর এলসির দেনা শোধ করতে হচ্ছে। তবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাত থেকে সে পরিমাণ আয় আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যায়। অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী বছরের রিজার্ভের স্থিতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। ওই ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০১৩ সালে নির্বাচনের বছরটিতে। সে বছর ১ হাজার ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন বছর ২০০৮ সালে। ওই বছর পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সূত্র জানায়, কয়েকটি উপায়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হয়। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি, ক্যাশ ও হুন্ডিতেই সবচেয়ে বেশি। যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সরকারি প্রণোদনা পেতে রপ্তানি পণ্যেও বেশি মূল্য দেখানো হয়। অথচ সেই আয় দেশে আসছে না। অন্যদিকে ভুয়া রপ্তানি আয় দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশের পণ্য ও সেবা খাতে প্রচুর পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে এক ধরনের টান সৃষ্টি হয়েছে ডলারের বাজারে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য আমদানিতে ৫ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২৮ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই আমদানি হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী যন্ত্রপাতি। অথচ এ খাতে আমদানি বাড়লেও শিল্প স্থাপন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে না।
এ ছাড়া এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৪০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আকুর বিল ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে উঠেছিল। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ- এ ৯ দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে, তার বিল দুই মাস অন্তর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আকুর বিল পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে আকুর বিল ছিল ১৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এদিকে আমদানিতে ডলারের চাহিদা মেটানো হতো রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে। আগে আমদানির পরিমাণ কম এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় বাড়তি ডলার থাকতো। ওইগুলো তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্রি করে দিতো ব্যাংকগুলো। ফলে বাড়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাবদ যা আসছে, তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার দিতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১০ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ৩ মে পর্যন্ত) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার কিনেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাকশিল্পের কাঁচামাল তুলা আমদানি ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ উৎপাদনে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই আমদানি-রপ্তানিতে মূল্য কারসাজির মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ইনিস্টিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার, যার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি-রপ্তানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।