গত কিছুদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে ও টিভির অনুষ্ঠান মালায় ও আলোচনা ও পত্র-পত্রিকায় আমরা জানতে পারি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র প্রতিনিধি (ডিইউসিএসইউ) নির্বাচনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই মিটিং মিছিল সমাবেশ করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রেখেছে। এই অবস্থায় চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আগামী ৬ মাস সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রুলিং জারি করে। তাসত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ছাত্ররা ভিসি অফিস ঘেরাও ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করতে থাকে। ভিসি ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় না আসায় ছাত্ররা ভিসি অফিস বেষ্টনীর তালা ভাঙিয়া ভেতরে ঢুকে অবস্থান ধর্মঘট পালন এবং ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকে। এ সময় সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের কয়েক শ নেতা অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করে। হামলাকারীরা নিরীহ ছাত্রীদের চুল ধরে নির্যাতন কওে ও অন্যদের বেধড়ক মারধর করে। হামলাকারীদেও এ অন্যায় আচরণ দেশব্যাপী সাধারণ জনগণের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ নির্বাচন জুন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এরপর ডাকসুর কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। হাই কোর্টের নির্দেশ আমলে না নেয়ার ফলেই এবারের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সরকার সমর্থক ছাত্র নামের নেতাকর্মীদের এই হামলা আইয়ুব-মোনেম খানের এনএসএফ বাহিনীর হামলার সমতুল্য। এই অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য সরকারি দলের নেতামন্ত্রীরা যা বলছেন তা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি উন্নয়নের সহায়ক নয়।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ সিদ্ধান্তে ডাকসুর নির্বাচন দিতে পারে না। আর এই ২৭ বছরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয় দলই ক্ষমতায় ছিল বা আছে। উভয় দলের ডাকসু নির্বাচনা না দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য সম্ভবত নি¤œরূপ :
সরকার ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
ডাকসু নেতৃত্ব যেন সরকারি বা দলীয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।
ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন পরাজিত হলে দেশব্যাপী সরকারি দলের ওপর বিরূপ প্রভার পড়ার ভীতি ইত্যাদি, ইত্যাদি। সোজাকথা নেতৃত্বের বিকাশ বন্ধ করা এবং সরকারদলীয় ও চাঁদাবাজ-লুটেরাজের স্বার্থে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
দেশের সার্বিক অবস্থা : বিএনপির শাসনামলে ব্যাঙ্ক থেকে প্রচুর অর্থ দেশে বিদেশে ব্যবসায়িক লেনদেন, এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট ও শিল্পায়নের নামে বিদেশে পাচার ও লুটপাট করা হয়। এ ছাড়াও বিএনপি নেতাকর্মীরা দেশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজ, লুটতরাজ, হয়রানি জবরদখল সমানে করেছে। এইসব ঘটনাবলি অদ্যাবধি বহাল রয়েছে। বিগত কিছুদিন যাবত প্রতি কেটি চালের দাম ৪০ টাকা হইতে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। ডালসহ অন্যান্য তরিতরকারির দামও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের দ্বারা ছাত্রীরা রাস্তায় টিজিং ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থানায় নেয়া হয়না। নেয়া হলেও তা লোক দেখানোর আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিচার বিভাগের অবস্থা আরও কাহিল। দলীয় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য তুঙ্গে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট হচ্ছে।
স্বাধীনতার বিগত ৪৭ বছরে দেশের কৃষি শিল্প অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সরকারি অর্থ লুণ্ঠন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন না হওয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশ বিচার বিভাগ কাজ করেনা। ফলে জনজীবন বিপন্ন। সরকারি দল ও দলের নেতাকর্মীদেও উপদ্রবে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। তাই সব সমস্যা ও অপকর্মের জন্য দেশের পরিস্থিতি দায়ী বললে ঠিক হবে না। তাই দেশের বর্তমান সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ছাত্রসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য।
বাংলাদেশে ছাত্রসমাজের আত্মনিবেদিত সংগ্রামের ফলেই বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তান নির্বাচন, অনুষ্ঠান ১৯৬৩ সালে হামিদুল হক শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে ১৯ দফায় ভিত্তিতে গণ-অভ্যুত্থান ও আইয়ুব শাহী সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয় এবং শেখ মুজিবকে ছাত্রসমাজের পক্ষ হইতে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান ইত্যাদি কর্মকান্ডে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা বাস্তবায়নে ছাত্রসমাজের ভূমিকা স্থিমিত হয়ে থাকতে পারে না। অতএব দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি দলের স্বৈরাচারি কর্মকান্ড বন্ধ করার ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের দুর্বার গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের যাবতীয় ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে দীর্ঘকাল ক্ষেপণ এবং আপোস করার কোনো সুযোগ নাই।
নিউইয়র্ক।