ডান্ডাবেড়ির কাহিনী এবং মানবাধিকার

শামসাদ হুসাম :

গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বিএনপির সাবেক এক সভাপতির সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অমানবিক এক কর্মকাণ্ড নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেলো সচেতন মানুষদেও মধ্যে। মনে হয় এত বড় গলায় এমনভাবে না বললেও চলবে। তবে বিষয়টা একেবারেই যে নাড়া দেয়নি মানুষকে, এমনটাও কিন্তু নয়। কারণ দেশের মানুষের মধ্যে এখন শুধুই গুম, খুন আর গায়েবি মামলা নিয়ে সীমাহীন আতঙ্কের দিন কাটানোর ইতিহাস। সে ইতিহাসটাও যে নেহায়েতই অমূলক, তাও কিন্তু নয়। আর সে কারণে দেখলেও না দেখার ভান করেন ইদানিং অেেনকেই। আর এ সংক্রান্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দেয়া তথ্য মতে শেষ হিসাব হলো- শুধুমাত্র চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ১২৫ জন! আর সাদা পোশাকে ৫০ জন মানুষকে তুলে নেয়ার মধ্যে সাতজন ফিরে আসলেও দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বাকি মানুষের কোন হদিস আর পাওয়া যায়নি। আর সেই কমিশনের দেয়া তথ্যানুযায়ী- বিগত পাঁচ বছরে কমিশনের কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে ৮৮১টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালের রয়েছে ৪৩৯টি। ঐ সময়ে ২০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। আর বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৬টির মতো।

আর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে মোট দুই হাজার ৮৮ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। আর গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ঐ সময়টাতে ৫২৫ জনের মতো। এই যখন দেশের মানবাধিকারের কথা বলে আইন প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে নিহত ও গুম হওয়ার চিত্র, তখন সাধারণ মানুষের এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কিংবা প্রতিবাদ করার সাহস যোগায় কোন সংবিধান?

সংবিধান অবশ্য সবসময়ই মানুষের জন্মগত অধিকার নিয়ে স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। যেমন মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যেমন একটা সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নামা রয়েছে, একইভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- ‘বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর কোন দন্ড দেয়ার কোন অধিকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগের থাকিবে না’। গত ২০ ডিসেম্বর বিএনপির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, মোহাম্মদ আলী আজম তার মায়ের মৃত্যুর কারণে গাজীপুর কারাগার থেকে তিন ঘণ্টার জন্য যখন প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের জানাজাতে শরিক হওয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন উপস্থিত জনতার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার দশা! আলী আজমের হাতে-পায়ে ডান্ডাবেরির কলঙ্কিত এবং বীভৎস উদাহরণ। তার আগে-পিছে নয়জন পুলিশ সদস্যের ব্যরিকেড। যেনো ভয়ঙ্কর কোন খুনের আসামি! খুনের আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছে আমাদের সংবিধান। কিন্তু যেহেতু তিনি বিএনপি নামক প্রতিপক্ষ একদলের সদস্য, অতএব ন্যায়বিচার পাওয়ার কোন অধিকার রাখেন না আলী আজম! আর সেই কারণে গায়েবি এক মামলার গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়ে ব্যক্তি আজমের সংবিধান প্রদত্ত সবধরনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে ডান্ডাবেরির আড়ালে নেহায়েতই এক অপরাধীর তকমা দিয়ে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো তার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বরত পুুলিশ সদস্যরা। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য বিষয়টির ব্যাখা দিয়েছেন। তার মতে, গত কয়েক দিন আগে পুলিশের হাত থেকেই কয়েকজন অপরাধী পালিয়ে গিয়েছিল, সে জন্যই এই বাড়তি সতর্কতা।

আসলে রাজনীতিতে প্রতিহিংসা বড় মারাত্মক। তার স্বরূপও অতীতে দেখেছে মানুষ। কাজেই প্রতিপক্ষকে ঘাঁয়েল করতে গিয়ে এমন অমানবিক কাজ বারবার দেশে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে ১৫ আগস্ট এবং একুশে আগস্টের ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে সাধারণ জনগণ। তারপরও একজন ব্যক্তি আলী আজমের প্রতি যে ব্যবহার করা হলো, সেটা শুধু অমানবিকই ছিল না, মানবাধিকারের পরিপন্থীও ছিল। আলী আজম তার মায়ের মৃত্যুতে এতটাই শোকগ্রস্থ ছিলেন যে, তিনি শুধু জানাজায় শরিক হননি, নিজে ডান্ডা বেড়ি শরীরে ধারণ করে ইমামতিও করেছেন। সেই ধরনের এক মুহূর্তে এই অমানবিক মানসিক নির্যাতনে তাকে ক্ষত-বিক্ষত না করলেই কি পারতেন পুলিশের সেই সময় দায়িত্ব পালনকারী কতিপয় নিমর্ম হৃদয়ের মানুষেরা। নাকি উঁচু মহলের নির্দেশেই এমন কাজটা করলেন সেই সব মানুষ, যারা শুধু চাকরি রক্ষার নামে নিজের বিবেককে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তিল পরিমাণ চিন্তা করতে নারাজ। এ লেখাটি শেষ করার আগে আরো একটি খবর খুব করে হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, আর তা হলো ঢাকার অভিজাত পাড়া বনানীর একটি বাসায় এক নাবালিকা গৃহকর্মীর নির্যাতনের কাহিনী। শিশু গৃহকর্মী প্রতিদিনই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই। কোন নতুন খবর নয়। কিন্তু খবরটা একটু অন্যমাত্রার অভিনব ছিল। প্রতিদিনই গৃহকর্ত্রী এবং কর্তার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশু কন্যাটি প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়ার দশা। আর তাদের নির্যাতনের ধরণটা এতটাই অভিনব যে, জানার পর সুখের ভাষা প্রায় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটেছে।

শিশু গৃহকর্মী ঐ মেয়েটির মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ করে শুধু তার উপর শারীরিক নির্যাতনই চালানো হতো না। ঐ সময়ে ঐ দুর্ভাগ্য কন্যাটির দুই হাতের তালুতে সুপার গ্লু ঢেলে দিয়ে অত্যাচারের নতুন আর এক মাত্রা যোগ করেছিলেন বনানীর ঐ পয়সাওয়ালা দম্পত্তি। পয়সাওয়লা হলেই শুধু বড়লোক হওয়া যায় না, মনের দিক দিয়েও বড়লোক হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে মানবিক হওয়া। নির্যাতিত শিশু গৃহকর্মীটি পালিয়ে জান বাঁচালেও তার কোন দরকার ছিল না, কারণ স্থানীয় থানার কর্মকর্তারা বিষয়টা নথিভুক্ত করেননি। তার অবশ্য দরকারও পড়েনি। যেহেতু অসহায় পরিবার তাদের কন্যাকে জীবিত ফেরৎ পেয়েছে, এ-ই তাদের কাছে বড় একটা বিষয়! শিশুটির ভাই নিজেই বলেছেন, বিচার চাইতে গেলে টাকা-পয়সার দরকার। তাদের কাছে টাকা-পয়সার অভাব রয়েছে। অর্থাৎ এই দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে পার পেয়ে গেলেন অসৎ ও অসাধু পরিবারটি। এবং ঐ পথ ধরেই দেশে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের মাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়েই যাবে। যদিও দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ নামে একটি আইনের বিধান রয়েছে। যার মৃত্যুদণ্ডের মতো সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বিষয়টি যেনো অনেকটাই কেতাবে থাকা, কিন্তু গোয়াল শূন্য অবস্থা!

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০০০ পরবর্তী সময়ে দেশে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৫ হাজার। এই হিসাবটা বেশ পুরনো, বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় দুই লাখেরও উপরে অথবা কাছাকাছি। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই হচ্ছে কন্যা শিশু। যাদের উপর আশ্রয়দাতা পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন একটা অলিখিত অধ্যায়। শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, যৌন নির্যাতনের শিকারে পড়ে জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়া ঐসব শিশু কন্যাদের জীবন কাহিনী উপন্যাসকেও হার মানাবে। এতটাই মানবাধিকারের পরিপন্থী! আর নির্মম সত্য হচ্ছে ঐসব নির্যাতনকারী পরিবারের সদস্যরা আবার উঁচু মহলের বাসিন্দা বা সচিব, উপসচিব, প্রফেসর থেকে শুরু করে বড় বড় রাঘব-বোয়ালেরা। নির্দ্ধিধায় এসব কাজ সামনেই করে যাচ্ছেন। এবং এ ব্যাপারে তাদের নির্লিপ্ততার পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে-দোষীদের কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রেফতার দেখানো হলেও টাকা দিয়ে প্রায় সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। মজার বিষয় হচ্ছে, যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজ-কারবার নিয়ে তার কর্মকর্তারা মুখে তুবড়ি ফোটান, তাদেরও এই ব্যাপারে সক্রীয় ভূমিকায় দেখা যায়। যেমন ঐ মানবাধিকার কমিশনের একজন প্যানেল আইনজীবী সারাহ সুদীপ ইউনুসকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তার ঘরে কর্মরত শিশু কন্যাটিকে জলন্ত মশার কয়েলের ছ্যাঁকা দিয়ে আহত করার অভিযোগে।

এ সংক্রান্ত খবর হলো- গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকাতইে ৩৯৩ জন শিশু গৃহকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘণের মতো এত বড় বড় ঘটনা কেবল বাংলাদেশেরই সম্ভব। যাদের রক্ষক হওয়ার কথা, তারাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায়- আমাদের মতো যাদের সাম্প্রতিক বসবাস দেশের সীমানার বাইরে, এসব খবরে তাদের ঘুমও এখন হারাম হওয়ার উপক্রম।