ডার্টি সেভেনটিতে বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী

দুষ্টের দমনে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ তত্ত্বে আ’লীগ

আজ রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রিসভা কক্ষে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভর্নিং বোর্ডের প্রথম সভায় অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -সংগৃহীত।

বিশেষ প্রতিনিধি : অতি বেড়ে যাওয়া নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের সামলানোর কোনো চেষ্টায়ই সাফল্য পাচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া, দল থেকে অব্যাহতিসহ সব চেষ্টাই মার খাচ্ছে। কিন্তু সংসদ সদস্য পদ থেকে সরানো যাচ্ছে না মুরাদ-পঙ্কজ ধরনের নেতাদের। সংসদের মতো সাংবিধানিক জায়গায় থাকায় তাদেরকে সম্রাট-খালিদ-পাপিয়াদের মতো জেলেও রাখা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। বিরোধী দল বা বড় বড় ঘটনা সামলে ফেলার ক্যারিশমা থাকলেও এই পেকে যাওয়া-বখে যাওয়া নেতা-পাতি নেতাদের কাছে অনেকটা ‘আন ডান’ অবস্থায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বিব্রতও হচ্ছেন মাঝেমধ্যে।
দলের সাংগঠনিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তত ৪০ জেলাই কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। এসব জেলায় আওয়ামী লীগের চেয়ে এমপি লীগ বেশি পরাক্রমশালী। কোথাও কোথাও এমপি বা তার স্বজন-নিকটজনেরা হাতও তুলছেন দলের কর্মীদের গায়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত আট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকেরা এ-সংক্রান্ত তালিকাসহ রিপোর্ট দিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে। এর বাইরে কারো কারো বিরুদ্ধে হিন্দু সম্পত্তি দখল, সীমান্তে চোরাকারবার, মাদক পাচারসহ জঘন্য নানা কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যার কিছু কিছু প্রধানমন্ত্রীও অবহিত হয়েছেন।
কেবল প্রতিপক্ষ নয়, দলীয় লোকজনকেও নয়; শিক্ষক-সরকারি কর্মচারী পেটানোর রেকর্ডও গড়েছেন এ তালিকার এমপিদের কয়েকজন। তাদের অনেকেরই এখন ইমেজ খারাপ। না সাধারণ মানুষ, না দলীয় নেতাকর্মী- কোথাও অবস্থান নেই। কারো কারো দলে বড় পদ নেই। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাববলয় তৈরি করে এমপি লীগ তৈরি করে টিকে থাকতে চাইছেন তারা। তাদের কেউ কেউ ছিলেন গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেকর্ডসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর নেপথ্য মদদদাতা। উপজেলা ও পৌর নির্বাচনেও তা-ই। তাদের অনুসারীরা যেখানেই নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি, সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তাই বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না থাকার পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতার রেকর্ড হয়েছে। এ ধরনের বিশেষ ৭০ এমপির তালিকা রয়েছে দলের হাইকমান্ডের কাছে।
দল বনাম এমপির পাশাপাশি কোথাও কোথাও প্রশাসন লীগও যারপরনাই তৎপর। ডিসি লীগ, এসপি লীগ, ওসি লীগ ইত্যাদি নামের প্রশাসনিক গ্রুপ কোথাও কোথাও একচ্ছত্র আধিপত্য গেড়ে বসেছে। বাস্তবিক কারণে কোনো গ্রুপের বিরুদ্ধেই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছেন না দলীয় সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাধ্য হয়ে উপরিউক্তদের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরির উদ্যোগের দিকে যেতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এখানেও বাধা। উদ্যোগটি এগোচ্ছে না। কেউ কেউ আপস বা ভারসাম্য শুনতেই রাজি নন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সূক্ষ্ম চেষ্টার অংশ হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে জেলা পরিষদকে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দ ব্যাপক। এর প্রশাসকদের কাজের আওতাও কম নয়। জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ ১২ ধরনের বাধ্যতামূলক কাজ করে জেলা পরিষদ। এ ছাড়া সাতটি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
এ অবস্থায় বেশ ভেবেচিন্তে ৬০ এর মধ্যে ৩১টি জেলায় এবার নতুন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নানা কারণে বঞ্চিত ও পেছনে পড়ে থাকাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে। মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে ‘বঞ্চিত-নিগৃহীত’ হিসেবে পরিচিত। তাদের ৬০ জনের মধ্যে ২৫ জনই ৭০ বছর বয়সী। ৮০ বছরের বেশি বয়সী রয়েছেন ৫ জন। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন সময় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন। জেলা পরিষদে তাদের জিতিয়ে আনার যথেষ্ট ম্যাকানিজম রয়েছে দল ও সরকারের হাতে। এমপিরা প্রভাব রাখতে পারলেও তাদের হারিয়ে দেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখেন না। কারণ, জেলা পরিষদে সাধারণ ভোটাররা ভোটার নন। এর ভোটার উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।
অন্তত জেলা পরিষদে ভোট দেওয়া প্রশ্নে তাদের দলের সিদ্ধান্ত খেলাপ করে এমপিদের কেনাবেচার পণ্য না হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তাদের পক্ষে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড বা পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে’ ধরনের প্রবাদ-প্রবচন দেওয়া হলেও কয়েক জেলায় তাদের নিয়ে সমালোচনা উসকে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই বয়স্কদের পক্ষে কাজের চাপ সামলানো কঠিন হবে। হবে কেবল বয়স্ক পুনর্বাসন। দলে অবস্থান শক্ত না থাকার পরও এমপির আস্থাভাজনদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিতে আধিপত্য, উন্নয়নমূলক কাজে খবরদারির মাঝে তারা কতটা পেরে উঠবেন- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।