ডালাস থেকে মোরতুজা করীম : টেক্সাসের জনপ্রিয় বাংলা নাট্যগোষ্ঠী ডালাস বাংলা থিয়েটার এবার মঞ্চস্থ করলো তাদের নবম প্রযোজনা শচীন সেনগুপ্ত বিরচিত নাটক ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’।
১২ ও ১৩ অক্টোবর আর্ভিং শহরের ডুপ্লী থিয়েটার মঞ্চে পরপর দুই রজনীতিতে পরিবেশিত হলো তাদের নাটকটি।
বাংলার নাট্যসাহিত্য ও নাটক জগতে ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ শতাব্দী প্রাচীন অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা নাটক। গ্রাম বাংলার যাত্রাপালা পর্বের সীমানা পেরিয়ে শহরের নাট্যমঞ্চ ছাড়াও শেষ স্বাধীন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’র জীবন কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র-এক ঐতিহাসিক ট্রাজেডি মহানায়ক। ১৮৫৭ সালে মুর্শিদাবাদের পলাশী প্রান্তরে কুটিল ও ধূূর্ত ইংরেজ বেনিয়ারা কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খাঁ ও সভাসদ জগত শেঠ, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারীর যোগসাধনে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটায়। পরাজিত নবাবকে মুর্শিদাবাদে হত্যাকারী মীরজাফর আলী খাঁ নবাব রূপে অধিষ্ঠিত হন। নবাব সিরাজ-উদ-দোলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নবাবের খালা ঘসেটি বেগমও সম্পৃক্ত ছিলেন।
বিদেশি ঐতিহাসিকগণ স্বাধীনচেতা বাঙালির মানসপুত্র নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রকে অবমূল্যায়ন করে উপস্থাপন করায় বিশিষ্ট বাঙালি ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র ১৯৯৮ প্রকাশিত তার সিরাজ-উদ-দৌলা ঐতিহাসিক বইটিতে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও প্রজাবৎসল সিরাজ-উদ-দৌলার প্রকৃত চরিত্রকে তুলে ধরেন। এর আগে সাহিত্যিক নবীন চন্দ্র সেন ১৮৭৫ সালে পলাশীর যুদ্ধ নামে এক কাব্য রচনা করেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রকে ১৯০৬ সালে প্রথম নাট্যরূপ দেন গিরিশ চন্দ ঘোষ। আর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ রচনা করেন শচীন সেনগুপ্ত ১৯৩৮ সালে। ১৯৩৮ সালের ২৯ জুন নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৫১ সালে সাহিত্যিক সিকান্দার আবু জাফর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার জীবন কাহিনি নিয়ে আরো একটি নাটক রচনা করেন। ডালাস মঞ্চে শচীন সেনগুপ্তের রচিত ঐতিহাসিক নাটকটিই প্রথমবারের মত মঞ্চস্থ করলো ডালাস বাংলা থিয়েটার।
নাটকটির মূল চরিত্র নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে অভিনয় করেন ডালাস বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও গুণী নাট্যশিল্পী মোহাম্মদ মহিউদ্দীন। তিনি এ নাটকের নাট্য নির্দেশকও। নাটকের অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেন তারা হলেন- লুৎফুননেসা-নাবিলা নুর কুহু, উম্মে জহুরা-সামিনা হোসেন, আমেনা বেগম-আতেনা আবেদিন, আলেয়া-অর্নিলা গুহ নোলক, গোলাম হোসেন-আব্দুল মালেক, মীর মদন-নাইম আহমেদ, মোহন লাল- মোহাম্মদ জিয়াউল হক, রওশন আরা-রিফাত জাহান, ঘসেটি বেগম-আল্পনা হক, মীরজাফর আলী খাঁ-শাহিন সাদত, মুশিয়ে সিনফ্রে-মুহাম্মদ মোয়াজ্জেদ হোসেন পল, রবার্ট ক্লাইভ ও মোহম্মদ আলী বেগ-সাবের হোসেন, গভর্নর ডেক-চৌধুরী সালাউদ্দিন মাহম্মুদ, উইলিয়াম ওয়াটস ও দূত-আনিসুজ্জামান মানিক, জগৎ শেঠ-জাকির রহমান ভুট্টো, রাজবল্লভ-ফাইজুল বারী অপু, উমিচাঁদ-ইউনুস খান, মীর মীরন-মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়া সাধারণ নাগরিকদের ভূমিকায় অভিনয় করেন-আনিসুজ্জামান মানিক, প্রিয়তোষ নাথ, ইউনুস খান, মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন পল, চৌধুরী সালাউদ্দীন মাহমুদ।
নেপথ্য সহযোগিতায় ছিলেন
মঞ্চ ব্যবস্থাপনায়-নাইম আহমেদ, মঞ্চ পরিকল্পনায়- মোহাম্মদ জিয়াউল হক, সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জাকির রহমান ভুট্টো, নেপথ্যে সঙ্গীত ও শব্দ নিয়ন্ত্রণে- সাব্বির মহীউদ্দীন মিশা, আলোকসজ্জা- সৌমিক মহিন, পোশাক পরিচ্ছদ-সালেহা মহীউদ্দীন জেনি, ইভা সাদত, মেকআপ- বুসরা খান ও তাজনিম বারী, প্রমোটার- আলপনা হক। এছাড়া অভ্যর্থনা ও প্রবেশপত্র ব্যবস্থাপনায় ছিলেন রফিকুল আলম, অনন্যা রহমান, নাইলা ইসলাম প্রমুখ।
টেক্সাস বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ডালাস বাংলা থিয়েটার অতি জনপ্রিয় নাট্যগোষ্ঠী। এদের নাটক মানেই হলভর্তি দর্শক। এ নাটকেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে উপেক্ষা করেই পরপর দুই রজনী হলভর্তি দর্শক নাটকটি উপভোগ করতে সমবেত হয়েছিল। অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রজাবৎসল, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা চরিত্রে মহিউদ্দিন ছিলেন অনবদ্য। আর দর্শকম-লীকে সবচেয়ে বিমোহিত করেছে আলেয়া চরিত্রে অভিনয়কারী শিল্পী অর্নিলা গুহ নোলক। ডালাস মঞ্চে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অভিনেত্রী চিত্রলেখা গুহ কন্যা নোলক এর এটাই ছিল সম্ভবত প্রথম অভিনয়। নৃত্যগীতে পারদর্শী নোলক তার অভিনয় কুশলতা দিয়ে নাটকটিকে আরও উপভোগ্য করে তুলেছেন। আবেগপ্রবণ দৃশ্যগুলোতে তার অভিনয় দর্শক অনেক দিন মনে রাখবে।
এছাড়া এ নাট্যগোষ্ঠীর অন্যান্য শিল্পীরা বিশেষত, আনিসুজ্জামান মানিক, জিয়াউল হক জিয়া, আলপনা হক, নাবিল নুর কুহু, জাকির রহমান, সাবের হোসেনসহ অন্যান্য নতুন শিল্পীরা সবাই স্বস্বচরিত্রে অভিনয়ে পারদর্শিতার ছাপ রেখে নাটকটিকে উপভোগ্য করে তুলেছেন। এ সময় ডালাস বাংলা থিয়েটারের পক্ষ হতে মহিউদ্দীন এবারের এ নাটকসহ বিগত সকল নাটকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ডালাসে বসবাসকারী বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও বাংলা জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন সদস্য শেখ হোসেন বিজয় ও তার পরিবারকে পরিচয় করিয়ে অভিনন্দিত করেন।
শুধু মঞ্চ অভিনয়ই নয়, নেপথ্য আবহ সঙ্গীত, মঞ্চ সজ্জা, পরিচ্ছদ, আলোক সজ্জা, সার্বিক ব্যবস্থাপনা, নির্ধারিত সময়ে নাটক শুরু সবকিছুই মিলিয়েই ডালাস বাংলা থিয়েটার এ পরিবেশনটিও ছিল অনন্য। এ নাটক উপলক্ষে চৌধুরী সালাউদ্দীন মাহমুদের সম্পাদনায় তথ্যবহুল একটি স্মরণিকাও প্রকাশিত হয়েছে।