অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন
রোজার মাসে কর্মব্যস্ততা, অফিস ইত্যাদি রাতে করতে পারলে ভালো হতো, দিনের বেলা পারতপক্ষে কম কায়িক পরিশ্রম করা দরকার। খাওয়ার বিশেষ কোনো নিষেধ নাই। আমরা অন্য সময় যা খাই তাই খেলে সমস্যা হতো না। রোজার সময় বিশেষ খাবার খাই বলেই সমস্যা হয়। ইফতারের প্রথম অর্থাৎ রাতের প্রথমার্ধে দিনের খাবারের অধিকাংশটুকু খেয়ে ফেলি, ৬ বারের খাবার ৩ বারে সারতে হয়। মিষ্টি জাতীয় খাবারও বেশি খাওয়া হয়। ক্যালরি ঠিক রেখে খেতে পারলেই হলো। নাশতা যদি ইফতার হয় ডিনার যদি সেহরি হয় তারাবির পর যদি লাঞ্চ করি তাতে সমস্যা নাই। সমস্যা হলো কেউ কেউ ইফতারেই রাতের খাবার সেরে নেন; অনেকেই শেষ রাতে কিছু খান না বরং ইফতারির পর থেকে সেহরি পর্যন্ত এটা-ওটা (স্ন্যাক্স) খেয়ে কাটিয়ে দেন। শেষ রাতে খেতে হবে রেগুলার খাবার। রোজাদারের জন্য মিষ্টি বাদ দিতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার ও ভাজাপোড়া কম খেতে হবে। ভাজাপোড়ায় তেল/চর্বি বেশি (চর্বিতে ক্যালরি বেশি)। ভুরিভোজ চলবে না। বারবার করে কম খাওয়া ভালো। আসলে রোজার দিনে খাবারের পরিমাণ, মেন্যু, সময় সবই বদলায়।
ফল : সবার জন্য ফল খাওয়া ভালো। ডায়াবেটিস রোগীর প্রতিদিন একটা মিষ্টি ফল খাওয়া উচিত। টক ফল খাওয়া খুব ভালো। আসলে ফলে ফ্রুক্টোজ থাকে। ফ্রুক্টোজ স্বাদে চিনির মতো মিষ্টি কিন্তু এতে গ্লুকোজ নেই। যে ফলে যত বেশি ফ্রুক্টোজ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সেটা তত ভালো। রোজার দিনে আমাদের খেজুর খাওয়ার অভ্যাস। খেজুর নিষেধ নয়। পরিমাণ (প্রতিদিন ৪-৫টি) ঠিক রেখে খেলে বরং উপকার।
রোজার দিনে ডাক্তারের বিশেষ দায়িত্ব
* রোগীর রোজা রাখার সামর্থ্য আছে কি না যাচাই করা
* রোজার সম্ভাব্য জটিলতা ও তার সমাধানের রোগীকে ধারণা দেয়া
* রোজা রেখে ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা করা যায় কি না তার ধারণা দেয়া
* ওষুধ ও ব্যায়াম সম্পর্কে ধারণা দেয়া
* সঠিক সহজ ডোজের ট্যাবলেট বাতলে দেয়া
রোজাদারের কী কী সমস্যা হতে পারে
ডিহাইড্রেশন : পানি কম খাওয়া, অপরিমিত কায়িক শ্রম, ওষুধ ইত্যাদির কারণে পানিস্বল্পতা হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাস্তবে কম হয়। এ জন্য রাতের বেলা পানি পুষিয়ে খেতে হবে। ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত খেয়ে যেতে হবে। দিনের প্রথমভাগে কাজ বেশি করা যেতে পারে। আসলে রোজার শুরুতে সমস্যা হলেও পরের দিকে অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া (হাইপো) : সুগার অনেক কমে গেলে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। স্বাভাবিক মানুষের গ্লুকোজ ২৫ মিমো বা তার কম হলেও হয়। যারা ডায়াবেটিসের ওষুধ খায় তাদের ৩৫ হলেই হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের পরিমাণ দেখার চেয়ে উপসর্গ দিয়েই হাইপো বিবেচনা করতে হয়।
ভীতি থাকলেও পরিসংখ্যান আমাদের এ ধারণাকে সমর্থন করে না। রোজা রাখলেই হাইপো হবে এ ধারণা ঠিক না। মনে রাখা ভালো ডায়াবেটিসের ওষুধ না খেলে হাইপো হয় না। সব ওষুধে হাইপো হওয়ার আশঙ্কা সমান নয়। ১২-১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলেও কারও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় না। যারা সালফোনিলুরিয়া ট্যাবলেট খায় ও ইনসুলিন নেয় তাদের হাইপো হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই ওষুধ ও ডোজ অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয়। সন্দেহ হলে আঙুল থেকে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। নিশ্চিত হলে মিষ্টি খেয়ে নিতে হবে। রাতের শেষ ওয়াক্তে সেহরি খেতে হবে। ইফতারিতে ভুরিভোজ আর সেহরিতে লাইট খাবার বা নো খাবারের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। দিনের বেলায় যথাসম্ভব কায়িক শ্রম কমাতে হবে। তারাবিতে কায়িক শ্রম ধরেই দিনের ব্যায়ামের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
কিটোএসিডোসিস, হাইপারঅসমলার স্টেট/ হাইপোগ্লাইসেমিয়া : এখানে ডিহাইড্রেশন একটা বড় ফ্যাক্টর বিশেষ করে বয়স্ক লোকদের। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ভয়ে ওষুধ অনেকেই বাদ দেয় বা অনেকে অযৌক্তিকভাবে কমিয়ে দেয়। পরিশ্রম কম করে বিধায় সুগার বেশি হয়ে যায়। গ্লুকোজসমৃদ্ধ খাবার এবং পার্টি ভোজন কম করা ভালো। মাত্রাতিরিক্ত সুগার (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) কমাতে ফাইন সুগার কম খেতে হবে। কমপ্লেক্স শর্করা (রুটি, ভাত) ও শাক-শবজি, ডাল, ফল এবং আঁশসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে।
খাদ্যনালির সমস্যা : ইফতারি ও সেহরিতে অনাভ্যস্ত খাবার ও রাস্তাঘাটের খাবার পাকস্থলীর সমস্যার কারণ। সারাদিন খালি থাকা খাদ্যনালি সবকিছু সহ্য নাও করতে পারে। কিছু কিছু ওষুধও বাদ দেয়া লাগতে পারে। বমি, পাতলা পায়খানা হলে, সোডিয়াম পটাশিয়াম কমে যাওয়ার ও প্রস্রাব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রোজার দিনে রক্ত পরীক্ষা
রোজার তিনমাস আগে থেকেই গ্লুকোজ কন্ট্রোল থাকলে এক মাসে কিছু হওয়ার কথা নয়, অযৌক্তিক কিছু না করলে। বাংলাদেশ, মিসর, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের আলেমদের মতানুযায়ী আঙুল থেকে রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙে না। যার গ্লুকোজ কন্ট্রোলে নাই সেহরির দু’ঘণ্টা পরে, ইফতারির আগে, ইফতারির দু’ঘণ্টা পরে এক/একাধিকবার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। নাশতার আগে ৬ মিমো ও খাওয়ার পরে ৮-১০ মিমো টার্গেট করতে হবে। বিকেল ৫টায় ৪ মিমোর কম হলে অন্য যেকোনো সময় ৩০০ মিগ্রাম (১৬৭ মিমো)-এর বেশি হলে রোজা ভেঙে ফেলা ভালো। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ হলে সুগার পরীক্ষা করে কনফার্ম করতে হবে, নিয়মমাফিক রোজা ভাঙতে হবে।
ওষুধ নিয়মিতকরণ : সহজতর উপায় হলো সকালের ওষুধটা সন্ধ্যায় অর্থাৎ ইফতারের পানি পান করে ওষুধ নিলে হয়। বাকিটা রাতে ভাগ করে খেয়ে নিলেই হলো।
ইনসুলিন : যারা দিনে দুই ডোজ নেন তারা সকালেরটা সন্ধ্যায় নেবেন। মনে রাখা সহজ হলো ইফতার অর্থ নাশতা। আমরা রোজার দিনে নাশতা করি সন্ধ্যায় তাই অন্য দিনের নাশতার ডোজটা ইফতারে (নাশতায়) নিলেই হলো। দ্বিতীয় ডোজটা শেষরাতে নিলেই হলো। (প্রেসক্রিপশনের প্রথম ওষুধ প্রথম রাতে, শেষের ওষুধ শেষরাতে)। তবে সতর্কতা হলো ইফতারের পানি পান করে ওষুধ খেতে/ইনজেকশন নিতে হবে; ইনজেকশন নিয়ে আগে খেতে হবে, খাওয়ার পর নামাজ; নামাজ পড়ে এসে খাবার নয় (হাইপোগ্লাইসেমিয়া ঠেকানোর জন্য)। রোজার প্রথম দিকে দ্বিতীয় ডোজটা অর্ধেক নেয়া যেতে পারে। ৪-৫ দিন পরে সেহরির পর (সকাল ৮-১০টা) সুগার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
সালফোনিলুরিয়া : সালফোনিলুরিয়া ২৪ ঘণ্টা কাজ করে তাই পারতপক্ষে সন্ধ্যায় এক ডোজে নেয়া ভালো। সালফোনিলুরিয়া শরীরে গ্লুকোজ কম থাকলে আরও কমায় অর্থাৎ খাই আর না খাই গ্লুকোজ কমাবেই তাই হাইপো হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সাস্টেইনড রিলিজ (এসআর) মডিফাইড রিলিজ (এমআর) ট্যাবলেটগুলো পছন্দনীয়।
মেটফরমিন : ইনসুলিন সেন্সিটাইজার। গ্লুকোজ বেশি না থাকলে গ্লুকোজ কমায় না, তাই হাইপো হওয়ার কথা না। দুই বেলা তিন বেলা এবং ফুলডোজে নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে মেটফরমিন ডায়রিয়া এবং বমির কারণ হতে পারে। সেজন্য সম্ভব হলে রোজার দিনে সর্বনিম্ন ডোজ দিতে হবে।
ইনক্রেটিন (ভিলডাগ্লিপটন, সিটাগ্লিপটিন, সেক্সাগ্লিপটিন), লিরাগ্লুটাইড : খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ইনসুলিন নিঃসরণ হয় এরা সেই ইনসুলিন ভাঙতে দেয় না। তাই রোজার দিনে সন্ধ্যাবেলার ডোজ নিরাপদ। তবে বমি বা ডায়রিয়ার ঝুঁকি থাকলে ডোজ কমাতে হবে। লিরাগ্লুটাইড সহ্য হয়ে গেলে সন্ধ্যাবেলায় একমাত্র ওষুধ এক ডোজ নিলেও হতে পারে।
এসজিএলটি ২ ইনহিবিটর : নতুন ওষুধ অভিজ্ঞতাও কম। এরা এমনিতেই ডিহাইড্রেশন করে, কিটোএসিডসিস বাড়ায় বিধায় ব্যবহার না করা ভালো। ইফতারে না নিয়ে মধ্য রাতে নেয়া নিরাপদ।
রোজাদারের ব্যায়াম
ব্যায়াম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাবশ্যক। রোজার সময় তারাবির নামাজের ঘণ্টাখানেকের শ্রম ব্যায়াম হিসেবে নিয়েই ব্যায়ামের প্লান করতে হবে। ইফতারের এক ঘণ্টা পরে কায়িক শ্রম করা ভালো। দিনের শেষ দিকে কায়িক শ্রম বাদ দিতে পারলে উত্তম। তারাবিতে যাওয়া-আসার রাস্তাটা ঘুরে গিয়ে লম্বা করা যেতে পারে।
পানি : গরমের দিনে রোজা, দিন বড়। পানির ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। পানিসমৃদ্ধ ফল শসা, টমেটো, তরমুজ, ডাব বেশি খেতে হবে। রাতের বেলা সন্ধ্যা শুরু থেকে সেহরির শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানি নেয়া চলবে। দিন বড় বলে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। দুনিয়ার অনেক দেশই আছে যেখানে দিন শুরু হয় ভোর ৫টায় শেষ হয় রাত ১০টায়। আসলে শরীরের অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্ষমতা অনেক বেশি।
রোজার উপকারিতা : ব্যক্তি-সংযম, সহমর্মিতার অভ্যাস বাড়ায়। চা কফি ধূমপান ইত্যাদি অনাবশ্যকীয় খাবার ও অভ্যাস/বদাভ্যাস ত্যাগ করা শেখায়। ত্যাগ, দান, ভাগাভাগি করে খেতে শেখায়।
স্বাস্থ্য : সারা দিনের অভুক্ততায় দূষিত পদার্থ ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস শরীর বার্ন করে।
রোজার আগে সবেবরাত, সবে মেরাজ ট্রায়াল হিসেবে নেয়া যেতে পারে; অনেকে বিধান মতো সপ্তাহে দুদিন রোজা রাখে। এগুলো সবই মুসলমান ডায়াবেটিস রোগীদের রোজার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভালো। তিন মাস আগে থেকে ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের চেষ্টা করলে রমজানের ৩০ দিনে কোনো সমস্যা হয় না।