এইচ বি রিতা
একজন মানুষ যখন আত্মঘাতী হয়ে ওঠেন, পোকা মেরে ঘর পরিষ্কারের মতোই নিপুণ হাতে মেরে ফেলেন পরিবারের সদস্যদের, তখন আমরা হতবাক হয়ে যাই। আমরা নির্মম ঘটনা এবং অপরাধ নিয়ে ভাবি। কিন্তু এমন ঘটনার পেছনের উৎস কী, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করি না।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া টেক্সাসের বাঙালি পরিবারে ছয় সদস্যের হত্যা আমাদের মনে নানান প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় ডিপ্রেশনে ভোগা ফারহান তৌহিদ (১৯) ও তানভীর তৌহিদ (২১) খুব নিপুণ পরিকল্পনায় তাদের বাবা-মা, বোন, নানিকে গুলি করে হত্যা করেন এবং অবশেষে নিজেরাও আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু কেন এই হত্যা-আত্মহত্যার প্রবণতা?
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হত্যা-আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরাধী এবং ভুক্তভোগীদের মধ্যে সম্পর্ক, পারিবারিক সহিংসতা, মাদকের ব্যবহার, অপরাধীর বয়স, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পর্ক পৃথকীকরণ, অস্ত্রের ব্যবহার, জেনেটিক, পরিবারে মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস এবং হতাশা বা ডিপ্রেশন।
হত্যা-আত্মহত্যার বহুবিদ কারণের মধ্যে আজ আমাদের আলোচনা ডিপ্রেশন নিয়ে।
ডিপ্রেশন কী?
কোনো ব্যক্তির দীর্ঘ সময় ধরে অবসন্ন মন, শক্তিহীনতা এবং উৎসাহহীনতাকে ডিপ্রেশনের আওতায় ফেলা হয়। অর্থাৎ ডিপ্রেশন মনের এমন একটি মানবিক অনুভূতি, যার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে বন্ধ করে দেয়। সাধারণত ডিপ্রেশন একক কোনো ঘটনা থেকে আসে না, এখানে ঘটনা এবং একাধিক কারণের মিশ্রণ থাকে। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, নিজের, পরিবেশের এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সম্মিলিত প্রকাশই হলো ডিপ্রেশন, যা রোজকার জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে।
ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো কী কী?
কোনো ব্যক্তি ডিপ্রেশনে পড়ে গেলে সেটার প্রাথমিক কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ক্রমাগত দুঃখবোধ করা, উদ্বিগ্ন হওয়া, অহেতুক মেজাজ, শক্তি হ্রাস, মনোযোগের অভাব, অসহায়ত্ববোধ করা, অপরাধবোধ বৃদ্ধি পাওয়া, নিজেকে অযোগ্য ভাবা, উত্তেজিত বা বিরক্তিকর অনুভূতি, ক্ষুধা ও ঘুমের পরিবর্তন বৃদ্ধি বা হ্রাস, পূর্বে উপভোগযোগ্য কার্যক্রমে আগ্রহের অভাব, আত্মহত্যার চিন্তা করা বা আত্মঘাতী আচরণ করা ইত্যাদি…!
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিপ্রেশন বা ডিপ্রেশিভ এপিসোডকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়-ইউনিপোলার ডিপ্রেশন আর বাইপোলার ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনের গভীরতারও প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন মাইল্ড ডিপ্রেশন, মডারেট ডিপ্রেশন, এবং সিভিয়ার ডিপ্রেশন। এর সাথে এসে জুড়ে বসতে পারে বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গও।
ডিপ্রেশনের কারণগুলো কী কী?
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মনোবিজ্ঞানীদের ধারাবাহিকভাবে অধ্যয়নগুলো দেখায় যে, ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর সাথে জড়িত এবং এর প্রভাবটি ক্রমবর্ধমান সময়ের সাথে ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপের ওপর আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। সেটি হতে পারে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, সম্পর্কের ভাঙন, প্রকৃত বন্ধু না থাকা, বেকারত্ব, পারিবারিক সহিংসতা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বিদ্যালয়ে বুলিং, পড়াশোনার চাপ, ভুল প্যারেন্টিং, চাইল্ড অ্যাবিউজ, প্রশংসা না পাওয়া, জেনেটিক ইত্যাদি।
আমরা জানি, কিশোর বছরগুলো মূলত একটি মানসিক চাপের সময়। এ সময় তাদের দেহের পরিবর্তন, চিন্তার পরিবর্তন এবং অনুভূতির পরিবর্তন হয়। এ সময়টাতে পরিবার, বন্ধুমহল, স্কুল বা স্বজনদের কাছ থেকে যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ, কলহ, সম্পর্ক ভাঙন, তিরস্কার, বিভ্রান্তি, ভয় এবং সন্দেহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুভূতি, যেকোনো কিশোর-কিশোরীর মানসিক চাপ বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ যেকোনো উদ্বেগ ও মানসিক চাপ যেকোনো বয়সের ব্যক্তিকেই ডিপ্রেশনে ফেলতে পারে।
আবার অনেক সময় পরিবার ও সমাজের সুখী ও সফল ব্যক্তিরাও ডিপ্রেশন এড়াতে পারেন না। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেও তারা পূর্বের লড়াইয়ের কথা ভেবে কিংবা কেউ তাদের প্রাপ্তির প্রশংসা করছে না ভেবেও ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন। এবং সে ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ডিপ্রেশনটা লজ্জাজনক ভেবে লুকিয়ে যান।
ডিপ্রেশন নিয়ে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো-ডিপ্রেশন কি জেনেটিক?
‘স্ট্যানফোর্ড স্কুল অব মেডিসিন’ অনুমান করে যে, ১০ শতাংশ আমেরিকান তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় মেজর ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। এবং এ ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরিবারে সন্তান এবং ভাইবোনদের মধ্যে এটা ছড়াতে পারেন। এবং কোনো ব্যক্তির পরিবারে যদি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত কোনো সদস্য থাকেন, তবে সে ব্যক্তি, একটি স্বাভাবিক পরিবারের ব্যক্তির চাইতে পাঁচগুণ বেশি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রাখেন।
ডিপ্রেশন নেটওয়ার্ক স্টাডিতে ‘ক্রোমোসোম থ্রিতে তীব্র হতাশার জন্য জিনোম একটি উল্লেখযোগ্য যোগসূত্র’ আর্টিক্যালটিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, একটি ব্রিটিশ গবেষণা দল এমন একটি জিনকে বিচ্ছিন্ন করেছে, যা ডিপ্রেশনে থাকা একাধিক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ক্রোমোসোম থ্রিপি ২৫-২৬ প্রায় ৮০০ টিরও বেশি ডিপ্রেশনে থাকা পরিবারে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, হতাশায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই এটি জেনেটিক্যালি ছড়াতে পারে। বাকি ৬০ শতাংশ পরিবেশগত এবং অন্যান্য কারণে হতে পারে। বলা হয়, যে ব্যক্তি ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তির সাথে একই পরিবারে বেড়ে ওঠে, সে ওই ব্যক্তির আচরণকে অনুসরণ করবে-এটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, যে শিশুটি পিতামাতাকে বিছানায় দিন কাটাতে দেখে, সে শিশুটি এই দৃশ্যটাকে কখনোই অস্বাভাবিক মনে করবে না।
ডিপ্রেশনে ভুক্তভোগীরা অনেক সময় নিজেও বুঝতে পারেন না যে তারা এই সমস্যাটিতে ভুগছেন। তখন পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুমহলকে সচেতন হতে হবে। সাধারণ লক্ষণগুলো নজরে পড়ামাত্রই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শুরুতে পরিবার থেকে কথা বলে নেওয়া অতন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার আগেই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সাধারণত ডাক্তাররা ইতিবাচক আলোচনা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। দীর্ঘ সময় তারা রোগীর সাথে কথা বলে কৌশলে ভেতরের কথা বের করার চেষ্টা করেন। তবে কোনো ব্যক্তি মেজর ডিপ্রেশনে থাকলে পরীক্ষা করার জন্য অপেক্ষা করা হয় না। কাউন্সেলিং করে, ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা শুরু করা হয়। ডিপ্রেশনের ওষুধ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং নিয়মিত ডোজ নিতে হয়। নির্ভর করে রোগীর মানসিক অবস্থার ওপর ডাক্তাররা কীভাবে চিকিৎসা দেবেন।
তবে ডিপ্রেশন থেকে সেরে উঠতে চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক ভূমিকার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। একজন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগীর সেরে ওঠায় তার পরিবারে সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময়, নিরাপদ একটি পরিবেশ থাকা ওষুধের মতোই কাজ করে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন অনুসারে, ডিপ্রেশন হলো বশ্বব্যাপী অক্ষমতার প্রধান একটি কারণ। বিশ্বব্যাপী সব বয়সের মানুষের মধ্যে ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত।
ডিপ্রেশনের জন্য কে দায়ী? এটা জটিল এক প্রশ্ন। ডিপ্রেশন যেকোনো বয়সে যেকোনো ছোটখাটো কারণেও হামলা দিতে পারে। তবে সেটা যদি সামান্য মন খারাপের বিষয় পর্যন্তই থাকে, সে ক্ষেত্রে পরিবার, বন্ধুমহল এবং নিজে নিজেই আমরা সেরে উঠতে পারি। দীর্ঘমেয়াদি হলেই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
ডিপ্রেশন যেহেতু মানসিক একটি সমস্যা, তাই সমস্যাটি নির্ণয় হওয়ার পর মেডিক্যাল চিকিৎসার পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক যত্নটির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা যখন একজন ব্যক্তি ডিপ্রেশনে ভোগেন, তখন তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন ভিন্ন একটি জগতে। বাহ্যিক জগৎ তার কাছে অনিরাপদ মনে হয়। সে ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্যারেন্টিং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। পিতা-মাতা, পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা ব্যক্তিটিকে দিতে পারে একটি নিরাপদ আশ্রয় এবং বিশ্বাস, যা তার সেরে ওঠার আরো একটি ওষুধ। এ সময় পরিবারের অবহেলা, অযত্ন বা নেতিবাচক আচরণ ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিটির মানসিক স্বাস্থ্যকে আরো ক্ষতিকর করে তুলতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, শিক্ষক