এবিএম সালেহ উদ্দীন :
ডিসেম্বর মাস। আমাদের মহান বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মহান বিজয় ও স্বাধীনতান সূর্য উদিত হয়। একাত্তর সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক আসে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ওই বছরের ষোলোই ডিসেম্বর ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের চূড়ান্ত দিন। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দান অর্থাৎ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
ডিসেম্বর মাস এলে স্বাধীন বাংলাদেশে যেমন আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্বজনহারাদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। লাখ লাখ শহীদ পরিবার ছাড়াও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারেও শোকের ছায়া নেমে আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা আর বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তারা মহান বিজয় দিবসকে স্বাগত জানান।
আমার বাবা আলহাজ লুৎফর রহমান পণ্ডিত ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। ডিসেম্বর এলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শৌর্যবীর্যের ইতিহাসবিধৌত স্মৃতিসম্ভারের সঙ্গে বাবার বেশ কিছু স্মৃতি চোখে ভাসে। আর এই ডিসেম্বর মাসেই আমার বাবা এ পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যান। এ জন্য স্মৃতিপটের সবকিছুতেই আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবার ছবিটিও সমুজ্জ্বল হয়ে ভাসে। শৈশব থেকে কৈশোরের কত স্মৃতি ভেসে আসে। মনে পড়ে বাবার সঙ্গে কৈশোরকালের কথা। কত চেনা-অচেনা মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চিরতরে হারিয়ে গেছেন। আমার বাবা ছিলেন সমাজের একজন সহজ-সরল আড়ম্বরহীন সাদামাটা মানুষ। জীবনে তার কোনো শত্রু কখনো দেখিনি। আমাদের ইউনিয়নের সবার মাঝে ছিল সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন। সমাজের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি গ্রামের সবাইকে অভয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের বাঁশঝাড়ের বাগান থেকে বাঁশ কেটে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের কাজে তিনি লাঠি সরবরাহ করেছিলেন। সংগ্রামের দিনগুলোতে দূরাগতদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কুলি-মজুরসহ যেকোনো ধরনের মানুষকে পেলেই সাবধানে ও সতর্কতার সঙ্গে চলার পরামর্শ দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দেশময় ছড়িয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য-বীর্য ও সাফল্যের খবর আসতে লাগল। গ্রামগুলো ফাঁকা ফাঁকা। যুবসমাজের বেশির ভাগই গ্রামে নেই। কেউ মুক্তিযুদ্ধে আবার অনেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে। ভোলা সদরে পাকিস্তানি আর্মি বহাল আছে। চরফ্যাশন, লালমোহন, বুরহানুদ্দীন, দৌলত খাঁসহ ভোলা মহকুমার স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে মিলিটারিরা হানা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের উৎপাত ও হানা দেওয়ার খবর আসছে। সর্বত্রই একটা চাপা উত্তেজনা এবং ভীতিকর অবস্থা বিরাজিত। নগর, বন্দর আর মফস্বলের বাজার-ঘাটে রেডিওর খবর শোনার জন্য উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে থাকে। গ্রামের ছোট বাজার আর চৌরাস্তার রেস্টুরেন্ট, টোল আর দোকানপাটে দেশের পরিস্থিতির খবর শোনার জন্য অধিক রাত পর্যন্ত মানুষকে বসে থাকতে দেখা যেত। আমাদের বাড়িসহ হাতে গোনা কিছু বাড়িতে রেডিও ছিল। সবাই খবর শুনতে আসত। আমাদের কাছারি আর বাড়ির সামনের স্কুলঘরে উৎকণ্ঠিত মানুষে ভরা থাকত।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকেও চরফ্যাশন বাজারের অনেক দোকানপাট লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তের খবর আসছে। এ ছাড়া লালমোহন, দুলার হাট, গজারিয়া ঘোষের হাট, আমিনাবাদ শশীভূষণসহ অনেক বড় বড় বাজারে ব্যাপক লুটতরাজ হয়েছে। থানার আশপাশের অনেক ঘরবাড়িতে হানাদার বাহিনী আগুন দিয়েছে। আমাদের বাড়ির দুই মাইলের মধ্যে হিন্দুপাড়া আছে। সেসব বাড়ির বেশির ভাগই জনশূন্য। দেশব্যাপী ঘোরতর বিপদের মধ্যেও বাটপার-গোছের কয়েকটি চিহ্নিত গোষ্ঠী আশ্রয়দাতা সেজে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের রক্ষক হিসেবে অনেক ধন-সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। বিশেষ করে, স্বাধীনের পর অনেক চিহ্নিত লোক সরকারের লোক সেজে অনেক হিন্দুর বাড়িঘর দখল করে নেয়। অধিকাংশই ফেরত দেওয়া হয়নি। অবশ্য এটা ঘটেছিল বিভিন্ন বাজারে, গ্রামে নয়। আমাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষজন স্বাধীনের পর যার যার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। তাদের খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
পাকিস্তানি আর্মি ও হানাদারদের ভয়ে আমাদের গ্রামের অনেক বাড়ির মহিলা ও শিশুরা দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ইউনিয়ন পর্যায়ের বাড়ির মধ্যে আমাদের বাড়িটি আর্মি দ্বারা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল সাফল্যের সঙ্গে চরফ্যাশন থানা অপারেশনের পর অধিকৃত অস্ত্রাবলিসহ রাত শেষে পরের দিন সকালের দিকে আমার বড় ভাই নুরুল হুদা মিয়াসহ হাইকমান্ড সিদ্দিকের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা (শতাধিক এবং কাঁধে রাইফেল) আমাদের বাড়ি এবং পার্শ্ববর্তী পাটওয়ারি বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। অনেকেই আমাদের বাড়ির সামনের মসজিদে জুমার নামাজ পড়েছিলেন। স্কুলঘর এবং কাছারিতে ছিল থাকার জায়গা। সবাই দুপুর এবং রাতের খাবার খেয়েছিলেন।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, চরফ্যাশনের থানা অপারেশনের আগের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মুখারবান্দায় ছিলেন। সেই ক্যাম্পে যারা খাবার পরিবেশন করতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পোস্টমাস্টার জনাব সোলাইমান। তিনি ছিলেন একজন তারুণ্যদীপ্ত সুদর্শন যুবক। ছিলেন বিবাহিত। তার কোনো সন্তান ছিল কি না আমার মনে পড়ে না। আমরা তাকে সোলাইমান ভাই বলে ডাকতাম। আমাকে স্নেহবৎসলরূপেই দেখতেন। আমার বাবাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন।
অতীব বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, অপারেশনের পর অর্থাৎ দিবাগত রাতে (গভীর রজনীতে) মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানকারী মুক্তিযোদ্ধা সোলাইমান গ্রুপের যোদ্ধাদের হাতে মর্মান্তিকভাবে তিনি নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তির একটি অপরিণামদর্শী ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কোনো রকম বিচার-বিবেচনা না করেই সোলাইমানকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে খালের পাড়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীদের সেটি ছিল এক মহা ভুল। পরে বুঝতে পারলেও আর কিছু করার ছিল না। সেই গ্রামের সদা হাস্যোজ্জ্বল পোস্টমাস্টার সোলাইমান ভাইয়ের পরিবারের বিষাদ আর শোকের ছায়া কখনো কাটেনি। আমার বাবা সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটি পেয়ে খুব বিমর্ষ হয়ে শোকাচ্ছন্ন হয়েছিলেন।
আমাদের গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে ডিসেম্বর মাসে কোনো মহিলা ও শিশু ছিল না। আমার মা-বোনেরাসহ আরো কিছু আত্মীয় আমার নানাবাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। তাদের জীবন আর মান-সম্মান বিপন্ন হতে পারে ভেবে বাবা সবাইকে দূরত্বে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাকে মায়ের সঙ্গে পাঠানোর শত চেষ্টা করেও পারেননি। আমি কিছুতেই যেতে রাজি ছিলাম না। বাড়িভরা কাজের লোক সবাই পুরুষ। রান্নাবান্না সবই পুরুষেরাই করছে। তখন ছিল শীতকাল। এখনো মনে আছে, হাঁড়ি-পাতিল আর ইয়া বড় ডেগে রান্না বসিয়ে সবাই একসঙ্গে খেতেন। আমার কাছে সেটি একধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ মনে হতো।
চরফ্যাশন থানা অপারেশন শেষে সব অস্ত্র ও গোলা মুক্তিবাহিনী তাদের হাতে নিয়ে নিল। তারা সেসব অস্ত্রসহ পরের দিন আমাদের গ্রামে চলে এল। সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রায় ১০০ লোক আমাদের বাড়ি এবং পাশের পাটওয়ারি বাড়িতে রাত কাটালেন। পরদিন তারা অন্যত্র চলে যান। আতঙ্কময় আমাদের হাসানগঞ্জ গ্রাম। চাপা উত্তেজনায় বাড়িঘর ফাঁকা ফাঁকা থাকলেও স্কুল বন্ধ ছিল বলেই আমাদের কিশোর মন ছিল আনন্দমুখর। বন্ধুবান্ধব মিলে একযোগে খেলাধুলা করতাম। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পুরোনো বাড়ির আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই আয়ুব আলী, মান্নান, ফুপাতো ভাই আমির, কিশোর, সুনীল, জান্টু, কাঞ্চনসহ সকল বন্ধুই আনন্দেই মেতে থাকতাম। কৈশোরের এ রকম আরো কত স্মৃতি মনে উঠলে এখনো উতলা হয়ে উঠি।
এদিকে পরের দিন আমার ভাইসহ মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র চলে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো বাড়িতে এক দিনের বেশি থাকতেন না। থাকাটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। মনে আছে, বাবা সবাইকে অনেক অভয় ও আশীর্বাদে বিদায় দিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছারি, স্কুলঘর, দূরস্থিত ছাড়া বাড়িতে বাবার অতি ঘনিষ্ঠ কয়েকটি হিন্দু পরিবারও ছিল। তাদের মধ্যে গোবিন্দ শীল, দেবেন্দ্র ডাক্তার (আমি তাদের কাকা বলে ডাকতাম), সুনীলদা, সুশীলসহ অনেকের কথা এখনো মনে আছে। মনে পড়ে গোবিন্দ কাকার ছোট ভাই দেশের খারাপ পরিস্থিতির কথা ভেবে সম্ভবত জীবন বিপন্ন হওয়ার ভয়ে দাড়ি রেখেছিলেন। তার পাকা দাড়ি সেভ না করার ফলে বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় একবার বাবার কাছে এসে ইসলাম ধর্মে দীক্ষার বিষয়ে তার চিন্তার কথা বললেন এবং বাবার নিকট পরামর্শ চাইলেন। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি প্রাণের ভয়েই তা করতে চাচ্ছেন। আমার বাবা বললেন, ইসলাম ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তির বিধান নেই। যা কিছু স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানেই করতে হয়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়। বাবা তাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ইনশা আল্লাহ তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। তোমরা নির্ভয়ে চলাফেরা এবং নিজেদের ধর্মকর্ম পালন করবে। আমরা তো আছি। সেটাই হয়েছিল। আমার আব্বা বেশ ধর্মপ্রাণ ছিলেন। সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সবাই তাকে মান্য করতেন।
চরফ্যাশন বাজার এবং দাসকান্দিতে হিন্দুদের বাড়িঘর যখন ভস্মীভূত ও বেদখল হয় (!), বাবা তখন মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি সর্বদা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে ছিলেন। আমাদের গ্রামের মানুষের পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। চরফ্যাশনের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তার বন্ধু বিনত বাবু পাক হানাদারদের কাছে ধৃত হয়েছিলেন। তিনি, তার ছেলে পিয়ালাল এবং আরও কিছু লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভোলা খেয়াঘাটে তিনি গুলিতে নিহত হন। ভোলা খেয়াঘাট ছাড়াও বিভিন্ন টর্চার সেল থেকে কয়েকটি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে পক্ষপাতের অজুহাতে ধরে নিয়ে যাওয়া নিরীহ মানুষদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হতো।
বিজয় দিবস এলে সরকারিভাবে তা ধুমধামের সঙ্গে উদ্্যাপন করা হয়। বেসরকারিভাবেও সমগ্র জাতি মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উদ্্যাপন করে থাকেন। কিন্তু দেশের অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা অনেকেরই মনে থাকে না।
বাংলাদেশের অনেক অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের করুণ স্মৃতি আমাদের কাঁদায়। ডিসেম্বর মাস এলে বিজয় দিবসের আনন্দের সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে আমাদের হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ডিসেম্বরে যখন বাংলাদেশের বিজয় দ্বারপ্রান্তে, যখন পাক হানাদাররা বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে; তখন সমগ্র দেশকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্তে স্বাধীনতাবিরোধী দোসরদের সহযোগে তারা ঘরে ঘরে হানা দিয়ে আমাদের মহান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে। দুই দিন পর তাদের লাশ রায়েরবাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানের গণকবরে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ পাওয়াই যায়নি। তারা চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান। বিজয়ের আনন্দের দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের মধ্যে কী রকম বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল; তা সহজেই অনুমেয়।
ডিসেম্বর এলে কৈশোরের গ্রামীণ জীবনের কত স্মৃতি মনে পড়ে। স্মৃতি তো এমনই, যা মানুষকে কাঁদায়, আপ্লুত করে।
ফিরে আসি বাবা ও মায়ের কথায়। কৈশোর না পেরোতেই বিদ্যার্জনের আশায় আমি বাড়িছাড়া। আমাদের বাড়ি থেকে সাড়ে তিন মাইল দূরে গজারিয়া বাজার। বাড়িতে লেখাপড়া হবে না বলেই বাজারের ঘরে থাকার ব্যবস্থার মাধ্যমে আমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মূলত তখন থেকেই বলা যায়, মা-বাবার নিকট থেকে দূরে ছিলাম। কিন্তু সর্বদা মা ও বাবার সামগ্রিক সাহায্য, মায়া ও মমতানির্ভর ভালোবাসাই ছিল আমার জীবনের ছায়াসঙ্গী। দেশে থাকাকালীন ছাত্রজীবনের সকল খরচের ব্যবস্থা হতো আমার প্রাণপ্রিয় মা ও পরম শ্রদ্ধেয় বাবার নিকট হতে। ডিসেম্বর মাস এলেই আমরা যেমন বিজয় দিবসকে উদ্্যাপন করি, তেমনি সকল শহীদকেও শ্রদ্ধা করি এবং সম্মান জানাই। কৈশোর থেকে আজ অবধি ডিসেম্বর মাস আনন্দের মাস, তেমনি সকল শহীদ পরিবার ও স্বজনহারাদের শোকের মাস।
শৈশবের অবাস্তব কল্পনার জগৎ থেকে ধীরে ধীরে কৈশোরের বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাই। সেই সময়কার অনুভব ও উপলব্ধির মাধ্যমে অতিবাস্তবকে বুঝে ওঠার সময়টাতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে। তেমনি কৈশোর ও ফুলে ভরা ছাত্রজীবনের ছবিসমূহ ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে।
আসলে মানুষের জীবনটা একধরনের স্মৃতিরই পাঠাগার। যে যত মনে করবে, স্মরণ করবে তত আপ্লুত হবে। কাঁদবে, হাসবে, জীবনকে রোমন্থন করবে। স্মৃতি হচ্ছে একধরনের জীবনসঙ্গী। অস্কার ওয়াইল্ডের একটা উক্তি মনে পড়ছে : ‘স্মৃতি হচ্ছে জীবনপাতার ডায়েরি, যা আমরা সবাই বয়ে বেড়াই।’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক