নূরুল ইসলাম : বর্তমানে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় ভাসছে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও। চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই আনন্দ-উৎসবের মধ্যেও চাপা আতঙ্কে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশবাসী। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা কথা। এই কর্মসূচি ঘিরে বাড়ছে বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাগ্যুদ্ধ। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। দিন যত ঘনিয়ে আসছে সাধারণ মানুষের মধ্যে তত বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষ অভিযান, ধরপাকড়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, গ্রেপ্তার, প্রচারণায় হামলা ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ নিজ অবস্থান জানান দিতে এরই মধ্যে শক্তি পরীক্ষায় নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারই অংশ হিসেবে বিএনপি সারা দেশে নয়টি বিভাগীয় গণসমাবেশ সফলভাবে শেষ করেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে দলটি। এ নিয়েই মূলত উত্তেজনা। বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের সফলতায় উজ্জীবিত হয়ে নানামুখী কথা বলেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। শুরুটা করেন দলের ঢাকা উত্তরের সভাপতি আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে।’ আমানের বক্তব্য নিয়ে যখন দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা-সমালোচনা, তখন বোমা ফাটানোর মতো এক বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুক। তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশে যোগ দেবেন খালেদা জিয়া।’ এর পরই জমে ওঠে রাজনীতির খেলা। পাল্টা জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয় কঠোর বক্তৃতা। খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে আবারও জেলে পাঠানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তবে বিএনপির নেতারা এখন বলছেন, মহাসমাবেশে খালেদা জিয়ার যোগ দেওয়ার কোনো আলোচনাই ছিল না।
এদিকে ডেডলাইন ১০ ডিসেম্বর একেবারে ঘনিয়ে এলেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি বিএনপির গণসমাবেশ আয়োজনের স্থান। সরকার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে বদ্ধপরিকর বিএনপি। যদিও বিএনপি বলছে, উন্মুক্ত জায়গা বলেই স্থানটি তাদের পছন্দের। আর সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলছেন, নাশকতা বা অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়। এ নিয়ে জটিলতা নিরসনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ ও বিএনপি। যদিও শেষ মুহূর্তে এসে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে সরকারের তরফে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রস্তাব এলে বিবেচনা করা হবে। তবে নয়াপল্টনেই কেন মহাসমাবেশ করতে বিএনপি বদ্ধপরিকরÑএ নিয়েও আছে নানা আলোচনা। সূত্রমতে, বিএনপির সবচেয়ে বড় কৌশল হতে পারে সরকারের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া। তেমনি ঢাকা অচল করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সারা দেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। নয়াপল্টনের রাস্তা পূর্ব দিকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলী পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তরে মিন্টো রোড-মন্ত্রিপাড়া। বিজয়নগরের নাইটিঙ্গেলের রাস্তা ধরে দক্ষিণে পুরানা পল্টন। পশ্চিমে প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। পুরানা পল্টন মোড় থেকে পূর্ব দিকে দৈনিক বাংলার মোড় হয়ে আবারও শাপলা চত্বর। রাজধানীর এই পুরো কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি হয়ে উঠবে নয়াপল্টনের জনসমাবেশের মূল কেন্দ্র। এ রকম পরিস্থিতিতে সমাবেশকারীরা সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত গণ-অবস্থানের ঘোষণাও দিয়ে বসতে পারে। তখন সরকারবিরোধী বিএনপির মিত্র অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিরও সেখানে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশ তথা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো সে রকম একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বিভাগীয় সমাবেশের স্থান হিসেবে নয়াপল্টনকে উপযুক্ত মনে করছে বিএনপি।
এসব বিষয়ে নানা কথা ডালপালা ছড়িয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব সূত্র ধরেই সরকার ও আওয়ামী লীগ বিএনপিকে প্রতিহত করার নকশা তৈরি করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে সংঘাতময় পরিস্থিতির। জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার চারটি প্রবেশমুখসহ প্রতিটি ওয়ার্ড ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সমাবেশের অন্তত দুদিন আগে থেকে সড়ক ও নৌপথে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট কার্যকর করা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার বিষয়ে অনড় থাকলে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হতে পারে।
এদিকে মহাসমাবেশে যোগ দিতে সারা দেশের বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ জন্য দলের দায়িত্বশীল নেতারা কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে দলটির পক্ষ থেকে গণগ্রেপ্তার চালানোর অভিযোগ করা হচ্ছে। গত ১ ডিসেম্বর পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) চিঠি দিয়ে রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক বেআইনি, মিথ্যা ও গায়েবি মামলা বন্ধের আহ্বান জানায় বিএনপি। বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ওইদিন আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চিঠি এবং জেলাভিত্তিক নেতাকর্মীদের মামলা ও গ্রেপ্তারের একটি তালিকা দেয়। বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, গত ২২ আগস্ট থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৯টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলায় নাম ধরে আসামি করা হয়েছে ৬ হাজার ৭২৩ জনকে। বেনামে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০ জনকে। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, গত ২২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩২৮টি গায়েবি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১০ হাজার ৩৮০ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ২৪ হাজার ১৭৩ জন। আর ৯৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপি সর্বশেষ জানিয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর রাত থেকে ৫ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত পাঁচ দিনে কমপক্ষে ১ হাজার ৩১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোশারফ হোসেন খোকনও রয়েছেন।
অন্যদিকে ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সমাবেশ ঘিরে র্যাবের নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি ও বিরোধী দল পালন করছে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বিদেশি স্থাপনা ও এমবাসি রয়েছে। ঢাকার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সব সময় সচেষ্ট রয়েছি। শুধু এই জনসমাবেশ ঘিরে নয়, আমরা সব সময় জননিরাপত্তা, দেশীয় ভাবমূর্তি রক্ষা, বিদেশিদের কাছে যেন দেশীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, এ জন্য সচেষ্ট রয়েছি। যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে র্যাব। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ডগ স্কোয়াডসহ হেলিকপ্টার ইউনিটও প্রস্তুত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিএনপির জনসমাবেশ ঘিরে র্যাবের পক্ষ থেকে রুটিন পেট্রল থাকবে, চেকপোস্ট থাকবে, সাইবার ওয়ার্ল্ডেও গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। যাতে কোনো ধরনের উসকানিমূলক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে নাশকতার চেষ্টা না হয়, সে জন্য র্যাবের সদস্যরা সাদা পোশাকে মোতায়েন থাকবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। তিনি বলেন, সমাবেশের নামে বিশৃঙ্খলা ও বাড়াবাড়ি করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, দয়া করে সংঘাতের দিকে যাবেন না। এমন কোনো পরিস্থিতির দিকে রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবেন না, যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ না থাকে।
মহাসমাবেশে কত মানুষের সমাগম হবে, সমাবেশ থেকে কর্মসূচিই-বা কী আসছে, এ নিয়ে যেমন মানুষের আগ্রহের কমতি নেই; তেমনি সমাবেশের আগে-পরে কিংবা সমাবেশের দিন অতীতের মতো নাশকতার শঙ্কায় তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ আর আতঙ্ক।