গ্রামবাংলা ডেস্ক : মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে পলি পড়ে ২২ কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ কারণে ২০১০ সালে পরিত্যক্ত হয়ে যায় চ্যানেলটি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক নৌ-প্রটোকলভুক্ত এই চ্যানেলের খননকাজ শুরু করে ২০১৪ সালে। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ নদী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মংলা-ঘষিয়াখালী। এর সঙ্গে যুক্ত করেছে আরও তিনটি নদ-নদী বগুড়া, বিষ্ণু ও রামপাল।
শুধু মংলা-ঘষিয়াখালীই নয়, ড্রেজিংয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে মৃতপ্রায় আরও ছয়টি নদ-নদী। সরু খালে পরিণত হওয়া নারায়ণগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র এখন খরস্রোত নদ। যৌবন ফিরে পেয়েছে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের কুমার ও আড়িয়াল খাঁ নদ এবং মধুমতি, শৈলদাহ ও কিশোরগঞ্জের নরসুন্ধা নদী। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, মোংলা-ঘষিয়াখালীর ৩২, পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ১০, কুমারের ৩২, আড়িয়াল খাঁর ২০, মধুমতির ৩৩ ও নরসুন্ধা নদীর ৩৫ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে উদ্ধার হয়েছে এক হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথ।
নাব্যতা ফেরানোর কাজ চলছে আরও এক হাজার ৫৫০ কিলোমিটার নৌপথের। বিশেষ প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৭৮টি নদ-নদীসহ ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধারে সরকার কাজ করছে। ড্রেজিংয়ের সঙ্গে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর জানিয়েছে, নদ-নদী রক্ষায় বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তিন প্রধান নদী যমুনা, পদ্মা, মেঘনাসহ মোট ৪০৫টি নদ-নদী, ছয় হাজার ৫৩৬টি খাল ও ১৮ হাজার ৪০৩টি পুকুর খনন করা হবে। প্রধান তিন নদী খননে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। বাকি নদী, খাল ও পুকুর খননে ধরা হয়েছে ছয় লাখ ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩ রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়ে ২৪ নৌপথ) প্রকল্প ও ১২টি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের খননকাজ চলছে। ইতোমধ্যে বলেশ্বর-পায়রা নৌপথ এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, পুনর্ভবা, তুলাই ও সোয়া নদ-নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। এ ছাড়া সাঙ্গু, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, ঘাঘট, বানার লোয়ার, নাগদা, জিনাই, গোমতী ও হাওরাঞ্চলের নদ-১৮টি নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং দ্বারা নাব্য বৃদ্ধি, নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নতি, পর্যটন, জলাভূমি, ইকোসিস্টেম, সেচ ও ল্যান্ডিং সুবিধাদি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কাজগুলো চলমান রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদী ও তুরাগ নদের ড্রেজিংয়ের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করার সুপারিশ করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, নদ-নদী সংরক্ষণবিষয়ক টাস্কফোর্সের তথ্যমতে, ৪৭ বছরে নদ-নদীগুলোয় পলি জমেছে প্রায় ১৭৮ কোটি টন। প্রতি বছর গড়ে জমা পড়ছে চার কোটি টন পলি। স্বাধীনতার আগে দেশে নৌপথ ছিল ২৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার। গত পাঁচ বছর আগে ছিল সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে তা সাড়ে চার হাজারে উন্নীত হয়েছে। জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মোজাম্মেল হক বলেন, মৃত নদ-নদীগুলো উদ্ধারের জন্য সরকার নির্দেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নৌবাহিনীকে। তিনি বলেন, ৩৩টি নৌপথ আমরা খনন করছি। এর মধ্যে আমরা ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন করব। বাকিগুলো খনন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে নদ-নদী খননে জনবল সংকটের চেয়েও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ড্রেজিংয়ের অপ্রতুলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার রয়েছে ২৫টি। আগামী জুলাইয়ে যুক্ত হচ্ছে আরও ১০টি। ডিসেম্বরে পাওয়া যাবে আরও ১০টি। মোট ৪৫টি হবে। আরও ৩৫টি ড্রেজার কেনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বেসরকারি মালিকানায় ১২৫টির মতো ড্রেজার রয়েছে। এর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এ ছাড়া বঙ্গ, অ্যাকুয়া, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েস্টার্ন গ্রুপেরও কিছু ড্রেজার রয়েছে। নদ-নদী রক্ষায় ১৫ বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। টার্গেট ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন। জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদ-নদী খনন ও ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা মরে যাওয়া নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কাজ করি। দেশের সব নদ-নদী একসঙ্গে এর আওতায় আনা সম্ভব নয়। পাউবোর বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, লোকবল সমস্যা রয়েছে। মেশিন কম। জাহাজ কম। মাত্র ১৪টি ড্রেজার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ড্রেজারের জন্য আবেদন করেছি। দুটি ড্রেজার এ বছরই পাবো। আরও ১২টির জন্য টেন্ডার করব বছর শেষে। তবে তা হাতে পেতে দুই বছর লাগবে। নিজেদের বেঁচে থাকার জন্যই নদ-নদী বাঁচানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদ-নদীর নাব্য রক্ষায় ড্রেজিং করা প্রয়োজন। শুধু নাব্যই নয়, আমাদের বিভিন্ন কর্মকা-ে নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে। নদ-নদী বাঁচানো জরুরি। অন্যথায় অস্তিত্বের হুমকিতে পড়বে প্রকৃতি ও মানুষ।