বিশেষ প্রতিনিধি : কূটনৈতিক পাড়ার খবরে সয়লাব ঢাকার রাজনীতি; যা কারও শঙ্কার, কারও সম্ভাবনার। কারও জন্য শনির, কারও জন্য মঙ্গলের। এর মাঝে কারও কারও বৃহস্পতি তুঙ্গে ওঠার পয়গাম। সঠিক তথ্য বোঝা বা আভাস দেওয়ার অবস্থা ঝানু জ্যোতিষীর পক্ষেও সম্ভব নয়। ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-দুবাই-সিঙ্গাপুর মেলানো নিউজ কেমেস্ট্রিতে উথালপাতাল অবস্থার ভবিষ্যৎ ঘুরছে অন্ধকারে। সেই অন্ধকারে কালো বিড়ালের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ক্ষমতাহীন বিরোধী দল বিএনপি, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে জামায়াত-হেফাজত সব দলই খবরের আইটেম। ইনু-মেনন থেকে নুর-হিরো আলম, সেন্টমার্টিন থেকে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন-সবই আন্তর্জাতিক, যেন বৈশ্বিক বিষয়।
জনসম্পৃক্ততার মোক্ষম সুযোগ কোরবানির ঈদেও এলাকামুখী না হয়ে ছোট-বড় দলের নেতারা পীর-মুর্শিদ খুঁজছেন গুলশান-বনানীর কূটনৈতিক পাড়ায়। শিডিউল না পেলেও বিদেশি মান্যবরদের দুয়ারে-উঠানে ঘুরছেন। সাক্ষাৎ পেলে ছবি ধারণ করে নানান জায়গায় দেখিয়ে নিজের ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের কর্মতৎপরতার মাঝে নিজেদের মঙ্গল আবিষ্কার করেন। এর মাঝেই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চীনের ফল, স্ন্যাক্স ও বিস্কুট উপহার নতুন বার্তা ও ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। খালেদা জিয়ার মতো সাজাপ্রাপ্ত নীরব-অসুস্থ ব্যক্তিকে উপহার পাঠানোর মাঝে বহু বার্তা পাচ্ছে বিভিন্ন মহল। সামনে চীন আর শেখ হাসিনাকে সোনার নৌকা উপহার পাঠাবে কি না-এ প্রশ্ন ঘুরছে।
সরকারি মহল কূটনৈতিক চাতুরীতে আগের মতো পেরে না উঠে নেমেছে নতুন নতুন অ্যাজেন্ডা সেটিংয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়া বাংলাদেশ চলবে না, দেশ বরবাদ হয়ে যাবে-এমন তত্ত্ব ও যুক্তি বাজার পাওয়ানোর জোর চেষ্টা চলছে। এর কিছুটা সাফল্যও পাচ্ছে সরকার। ভালো-মন্দ প্রশ্ন নয়, ‘দেশ চালাতে শেখ হাসিনাকে লাগবেই’ তত্ত্বটি নানা সমীকরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা বেশ জোরদার। বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠার বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। গোয়ালের গরু গোয়ালে ফেরত না এসে উপায় নেই প্রবাদকে গ্রহণযোগ্য করতে সামনে আনা হচ্ছে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের টাকা সরিয়ে আনার সম্ভাবনাকে। না এলে বা আনতে না পারলে এর জন্য বিএনপি-জামায়াতকে নব্য রাজাকার, রাষ্ট্রবিরোধী বানানোর মেশিনারিজও প্রস্তুত। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক-এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের অর্থ প্রায় ৮২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক লাফে এক বছরে ৯৪ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্যটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন দেশে অর্থপাচারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংবাদটি মার্কেটিংয়ের পেছনে সরকারের একাধিক সংস্থা ও মহলের সম্পৃক্ততা আঁচ করছেন অর্থনীতি জানা-শোনারা। হঠাৎ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ার জন্য দেশের চলমান ডলার সংকট বড় কারণ হতে পারে। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে, তা নয়। ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ জমার পরিমাণও কমেছে।
অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজার মধ্যে তথ্য ও বাস্তবতার এমন হেরফেরের মাঝে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের জুলাইতে ঢাকায় আসার খবর। যার নেতৃত্ব দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিশেষ দায়িত্ব তার। প্রাক নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণে আসবেন তিনি। তা মোটেই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন দেখতে নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়াদি নিয়ে। আলাদা কথা বলবেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের পরিবেশ বিরাজ করছে কি না তা যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করছে। সেই বিবেচনায় নির্বাচনের মাত্র মাস ছয়েক আগে এমন উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই একটি চাঞ্চল্য রয়েছে। ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড এবং ডোনাল্ড লু আতঙ্কের মাঝেও ভয় নয়, জয়ের আমেজ দেখাতে চায় সরকার। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কাউকে ভয় পান না-সেই বার্তা দেওয়া হচ্ছে বেশি বেশি করে। বাংলাদেশের কারও ওপর যেন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা রেস্ট্রিকশন না দেয়, সেই লবিংয়ে সরকার ভেতরে ভেতরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে প্রচারণা আছে।
এই ফাঁকে আবার ঢাকা ঘুরে গেছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন প্রধান তথা আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যাঁ-পিয়েরে ল্যাক্রোক্স। মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত কেউ যেন মিশনে যেতে না পারে, তিনি তা নিশ্চিতের দায়িত্ব দিয়েছেন সরকারকেই। এতেও এক গোলকধাঁধা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদেরকেই দায়িত্ব দেওয়ার কূটনৈতিক মর্ম বোঝা যেনতেন বিষয় নয়। তার ওপর আরেক ধাঁধা বাধিয়ে দিয়েছে বিএনপি। এত দিন প্রচার ছিল তারা গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি জড়িতদের তালিকা তৈরি ও তা জায়গামতো সরবরাহ করছে। এখন বলছে, এমন কোনো কাজ তারা করছে না। গুম-খুন-নির্যাতনে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তালিকা করার তথ্যকে গুজব বলে দাবি করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তার এমন দাবি দলের ভেতরে-বাইরে প্রশ্নের সঙ্গে কালো বিড়ালের চক্করকে আরও গতিময় করে তুলেছে।