বেশ কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা আর বাসযোগ্য নয়। পুরো বাংলাদেশে নেতিবাচক যা কিছু ঘটে, তার অভিঘাত প্রচণ্ডভাবে ঢাকার ওপর বর্তায়। এ বছরের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইনটেলিজেন্স ইউনিটের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে ঢাকা। নারীর জন্য নিরাপত্তা ও যৌন সহিংসতা বিবেচনায় নিলে ঢাকার স্থান চতুর্থ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক চাপের স্থান বলে ঢাকা বিশিষ্ট। অতিসম্প্রতি চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট–এর গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণজনিত মৃত্যুতে বাংলাদেশ শীর্ষে। জীবনমানের বিভিন্ন সূচকে ঢাকা ক্রমাগত নিচে নামছে—এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলো সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন রেখেছে, ‘ঢাকা আর কত নিচে নামলে সংশ্লিষ্ট সবার টনক নড়বে?’ (১৮ অক্টোবর, ২০১৭)।
২০৩০ সালের মধ্যে যে সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার আশা রাখে এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিডব্লিউসি’র মতে উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার স্থিতিশীলভাবে ঊর্ধ্বমুখী বিধায় তা সম্ভব বলে উল্লেখ করেছে, সেই দেশের রাজধানীর এই অবস্থা কেন?
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যে উন্নয়নের ধারা শুরু হয়, তার উৎস ছিল গ্রামবাংলা। গ্রামবাংলার সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলো, যথা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, সর্বোপরি দারিদ্র্য হ্রাস করে উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যয়ের সিংহভাগ ঢাকায় হওয়ায় অন্যান্য জেলায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য, বিশেষ করে জীবিকার সন্ধানে রাজধানীমুখী হতে হয়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেলাভিত্তিক প্রকল্প থাকলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকার অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার ওপর চাপ বৃদ্ধির সুযোগে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ, দখল, দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস, দুর্ঘটনা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও যাতায়াতব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যার একটির বাহ্যিক রূপ ঢাকার বিখ্যাত যানজট। সেই সঙ্গে বাড়ে নারীর নিরাপত্তাহীনতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জীবনমানের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ঢাকা একটি মেগা শহরে পরিণত হয়েও আধুনিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাবে বসবাসের যোগ্যতার সূচকে ঢাকার নিম্নমুখী অবস্থানে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই।
এ ক্ষেত্রে সরকার ও ঢাকাবাসী সবার টনক নড়তে হবে; আমাদের ভালোবাসার ঢাকাকে আবার একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের, জেলা প্রশাসক ও মেয়রদের, সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। বিশেষভাবে ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হলে ঢাকার বাইরে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরের সংখ্যা ৭১ লাখ। তাদের জন্য জেলায় জেলায় মানসম্মত শিক্ষা, বিশেষভাবে কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের কর্মসংস্থান স্থানীয় পর্যায়ে হতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট জেলাভিত্তিক প্রয়োজন চিহ্নিত করে অনুরূপ বরাদ্দ করতে হবে।
ঢাকার বিখ্যাত যানজটের কারণ রাস্তায় চলা যানবাহনের সংখ্যাধিক্যই নয়, তার চেয়ে বড় কারণ আইন অমান্য করে চলাচল। এ ক্ষেত্রে আইনের কঠিন প্রয়োগ হওয়া উচিত। আইন অমান্য করার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যায়ও বাংলাদেশ সবচেয়ে ওপরে। বিশ্বের অন্য অনেক বড় শহরে, যেমন জাকার্তা বা সিঙ্গাপুরে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জাকার্তায় যেকোনো গাড়িতে ন্যূনতম তিনজন যাত্রী থাকতে হয়, তা না হলে টোকেন কিনে বাড়তি টাকা দিতে হয়। সিঙ্গাপুরে এক দিন জোড় নম্বরের গাড়ি, আরেক দিন বিজোড় নম্বরের গাড়ি চলাচল করতে পারে, অন্যথায় অনুরূপ বাড়তি টাকা দিতে হয়।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে এবং কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আশির দশকে সরকার একবার ঘোষণা করেছিল, বিশেষ কিছু মন্ত্রণালয় ও দপ্তর ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। এখনো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, যাতে দেশের অন্যান্য এলাকাতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে এবং তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়।
একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের যে বাংলাদেশ গড়েছি, তার রাজধানী হিসেবে ঢাকা হবে সব ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিক সুবিধা প্রদানে সক্ষম এক ‘মেগাসিটি’। বসবাসযোগ্য শহরের তালিকার এক নম্বরে থাকবে ঢাকার অবস্থান। এ জন্য এখনই সংশ্লিষ্ট সবার টনক নড়া চাই।