ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ৯৬ এর জুন থেকে সেশনজট থাকবে না

ঠিকানার সাথে সাক্ষাৎকারে ভিসি ডঃ এমাজউদ্দীন

সাঈদ-উর-রবঃ বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষক- বুদ্ধিজীবী মহলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী ডঃ এমাজ উদ্দীন একটি প্রিয় নাম। প্রফেসর এমাজ উদ্দীন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি।
ডঃ এমাজ উদ্দীন সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যাদের পদচারণায় বিশ্ব বিদ্যালয় অঙ্গন ছিল এক সময় মুখর, আবার তারাই দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপিঠের প্রধান কান্ডারী হিসেবে হাল ধরেছেন শক্ত হাতে।
ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৪ সালে ডঃ এমাজ উদ্দীন ছিলেন ফজলুল হক হলের ভিপি। কালের চাকায় হারিয়েছে সময়। জীবন সংগ্রামের উত্থান পতনে ডঃ এমাজ উদ্দীন অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার জীবনে। রংপুর কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে এক সময় ছিলেন সে এলাকার একজন খ্যাতিমান শিক্ষক অভিভাবক। ঐ সময়ই তিনি রচনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর তার সাড়া জাগানো জনপ্রিয় পুস্তিকা- আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে ডঃ এমাজ উদ্দীনের লেখা পুস্তিকাটি একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের এই কৃতি শিক্ষাবিদ মন্ট্রিয়েলের ডাউন টাউনে নবম বাংলাদেশ সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে কানাডা এসেছিলেন। দেশের শিক্ষাঙ্গন, ছাত্র রাজনীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন সাপ্তাহিক ঠিকানার সাথে। নিচে তা হুবহু প্রকাশ করা হলোঃ
প্রশ্নঃ উত্তর আমেরিকায় বসবসারত বাংলাদেশীদের মিলনমেলা বলে কথিত এবারের সম্মেলনে আপনার অভিজ্ঞতা বলবেন কি?
উত্তরঃ সার্বিক বিশ্লেষণে নিঃসন্দেহে তা ভাল লেগেছে। তবে এই সম্মেলনটা যদি সব বাংলাদেশীদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হত তাহলে এটা হত আরো আনন্দের। সত্যিকার অর্থে সম্মেলনের উদ্দেশ্য তখনই সফল হতো যদি আমরা পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে একসাথে সম্মেলন করতে পারতাম। বিষয়টি আরো দৃষ্টিকটু হয়েছে এ কারণে যে একই নগরীতে দুটি সম্মেলন হচ্ছে ফোবানার নামে। এ ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমি যখন দেশে ফিরব তখন বিভক্তির এ দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে আমাকে বিব্রত করবে।
প্রশ্নঃ আপনি ত এক সময় কানাডায় ছিলেন। আপনাদের সময় এবং আজকের মধ্যে কি পার্থক্য আপনার চোখে পড়ে?
উত্তরঃ তখনকার দিনের কথা চিন্তাও করা যায় না। বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিল হাজার দশেকের মত। মাছ-ভাত ছিল অনেকটা দুর্লভ। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতাম ভাত-মাছ খাওয়ার জন্য। এখন এখানে বাংলাদেশী লোকসংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মত-পার্থক্য। অর্থাৎ যত লোক তত মত।
প্রশ্নঃ আমাদের দেশ ও মানুষের ইমেজ বৃদ্ধির জন্য প্রবাসীদের কি করা উচিত?
উত্তরঃ যারা বিদেশে এসেছেন তাদের সকলেরই নিজস্ব রূপকে বিবেচনায় রাখা উচিত। এমন কিছু করা উচিত নয় যার সাথে আমাদের রুট ও শিকড়ের সম্পর্ক নেই। যদিও এসব দেশে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা আছে তবুও আমাদের আবহমান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।
আমি যখন কানাডায় ছিলাম তখন বুঝেছি শিকড়ের টান কি। যার ফলে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যেতে পারি।
প্রশ্নঃ প্রবাসে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাশ করা বা এখানকার ডিগ্রীধারী অনেক বাংলাদেশী আছেন যাদের মেধা ও মননকে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন কাজে লাগাতে পারে। আপনাদের এ ধরনের কোন পরিকল্পনা আছে কি?
উত্তরঃ দেশে এখন এগারটি বিশ্ব বিদ্যালয় আছে। এছাড়া নতুন হয়েছে ১০টি প্রাইভেট বিশ্ব বিদ্যালয়। এতে পড়াশুনার সুযোগ আগের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে অনেক। দেশে পড়াশুনার সুযোগ কম থাকলেও যারা বিদেশে আছেন অভিজ্ঞতার জন্য মাঝে-মধ্যে তাদের দেশে গিয়ে পড়াশুনা করা উচিত। এখানে যারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত নিঃসন্দেহে দেশ তাদের সার্ভিসকে ডিজার্ব করে। আমাদের বিশ্ব বিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েশনকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসার জন্য আমরা ৯৬ থেকে তিন বছরের অনার্স কোর্সকে ৪ বছরের কোর্সে রূপান্তরিত করেছি। বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে কিছু কিছু অনুষদ খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ম্যানেজমেন্ট নিউট্রিশন ও কম্পিউটার সাইন্স খোলার ব্যাপারে আমরা তাদের উৎসাহ দিচ্ছি।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বিশ্ব বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে চ্যান্সেলর বলা হয়। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম কেন?
উত্তরঃ বাংলাদেশে বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোর ৯৫% অনুদান আসে সরকারি খাত থেকে। যার ফলে সরকারের একটা প্রবণতা আছে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার।
জাতীয় পর্যায়ে এর সপক্ষে জনমত গঠন করতে হবে। আমরা এ মুহূর্তে এ সব ছোটখাটো বিষয়কে উপেক্ষা করে বড় সমস্যার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি।
প্রশ্নঃ ডাকসুর নির্বাচন হয় নি। আপনি কি মনে করেন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে তা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হবে?
উত্তরঃ ডাকসুর নির্বাচন নিঃসন্দেহে পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হত। তবে নির্বাচন নিয়ে যে মারামারি, খুনাখুনির আশঙ্কা তাতে আমি এর দায়দায়িত্ব নিতে পারব না। এরপরও যে সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার ও ওরিয়েন্টেশন এর অন্যতম। খুশীর কথা যে জুলাই ৯৩ থেকে আজ পর্যন্ত কোন পরীক্ষা পেছানো হয় নি। এর আগে সেশন জট ছিল তিন বছরের। ৯৬ এর জুন থেকে বিশ্ব বিদ্যালয়ে কোন সেশন জট থাকবে না।
ডাকসু নির্বাচন ও গ্রাজুয়েশন কনভোকেশন অনুষ্ঠান এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্ব বিদ্যালয়ে বড় ছাত্র সংগঠন হচ্ছে ছাত্রদল, দ্বিতীয় ছাত্রলীগ। অন্য ছোট দলগুলো অনেক সময় কথা বলার সুযোগ পায়না। এই প্রবণতা ভাল নয়।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিবেশ ঠিক রাখার লক্ষ্যে প্রতি মাসে আমরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠক করি। এর ফলে আগের চেয়ে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের বিচরণ কমেছে। ৩/৪ ডজন অস্ত্রধারী এখনো আছে। এরা অস্ত্র ডিপোজিট করে নি। ডিজিএফ আই, এন এস আই ডিটেকটিভরা এদের চিনেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা নিরাপদেই বিচরণ করছে। বিশ্ব বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় ২৭টি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবির ও এরশাদ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে কোন এন্ট্রেন্স দেয়া হয় না।
প্রশ্নঃ শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতির প্রবণতা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
উত্তরঃ ৭৩ এর বিশ্ব বিদ্যালয় অধ্যাদেশের আওতায় অনেকেই এর সুযোগ পাচ্ছেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা অন্তরায় বলে আমি মনে করি না। বিশ্ব বিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে সাদা বিএনপি, ব্লু আওয়ামী লীগ এবং পিঙ্ক প্যানেল বামপন্থীদের।
প্রশ্নঃ বিশ্ব বিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে আসা শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বিদেশ থেকে দেশে ফিরেন না। তাদের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছেন?
উত্তরঃ এ ধরনের অভিযোগে ৯৪ এর জুলাই পর্যন্ত ৫২ জন শিক্ষকের চাকুরি গেছে। যারা বৃত্তির জন্য ছুটি নেন, ছুটি শেষ হওয়ার এক বছর পর্যন্ত তাদের জন্য অপেক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ফেরত না গেলে তাদের কাছ থেকে সরকারি দেনা-পাওনা তাদেরই বিভিন্ন ফান্ড থেকে কেটে নেয়া হয়।
প্রশ্নঃ রাজনীতি নিরপেক্ষ শিক্ষক হিসেবে ভিসির আসন পেলেন কিভাবে?
উত্তরঃ ১৯৫৪ তে আমি ফজলুল হলের ভিপি ছিলাম। এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি এর সমস্যা জানি। অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষকের নাম জানি আমি। এই হিসেবে সবার সাথে একটা দাবির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভিসি নির্বাচনে আমি ৮৪ ভোটের মধ্যে ৫৪টি ভোট পেয়েছিলাম। প্রশ্নঃ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার কি?
উত্তরঃ ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো চলছে। এই ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। শিক্ষাকে সময়োপযোগী করার সামর্থ পুরোপুরি না হলেও নিঃসন্দেহে এর পরিবর্তন দরকার।
প্রশ্নঃ বিশ্ব বিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল এডুকেশন বিভাগ খোলার কোন পরিকল্পনা আছে কি?
উত্তরঃ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি নি। এটা দরকার। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হবে।