তপস্যাকাল হচ্ছে-আত্মশুদ্ধির সময়

সাড়া বিশ্বে কাথলিক খ্রীস্টান মন্ডলী ক্যলেন্ডার বছরটাকে ৫টি ভাগে ভাগ করে উপাসনা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বছরের ১ম ভাগ হচ্ছে আগমন কাল অর্থাৎ যীশুর জন্মের পূর্বের সময়টাকে নিজেদের অন্তর আত্মা প্রস্তুত করার জন্যেই এই সময়টার নাম আগমন কাল, শিশু যীশুর আগমন ঘটবে তারই অপেক্ষা। শিশু যীশু যেন আমাদের অন্তরে জন্ম নিতে পারে তার জন্যই নিজেদের প্রস্তুত করা। পরের সময়টি জন্মোৎসব কাল অর্থাৎ প্রভু যীশুর জন্মের ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ২টি সপ্তাহ পর্যন্ত এই জন্মোৎসবকাল। এই সময়ের মূল ফোকাসই হচ্ছে আনন্দ ও শান্তি।

এর পর হচ্ছে সাধারণ কাল। উপাসনার এই সাধারনকালটিই মূলত দীর্ঘ। সাধারণকালের পরেরর সময়টা হচ্ছে প্রায়শ্চিত্তকাল বা তপস্যাকাল উপবাসকালও বলতে পারি। সারা বিশ্বে খ্রীস্টান কাথলিক মন্ডলী ৬ মার্চের বিশেষ উপাসনার মধ্য দিয়ে শুরু করে এই তপস্যাকাল। ৬ মার্চ সারা বিশ্বে খ্রীস্টান ক্যথলিক মন্ডলী ভস্ম বুধবার শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য পরিবেশে পালন করে। কপালে ভষ্ম বা ছাই মেখে যাজকগণ স্মরণ করিয়ে দেবেন ‘হে মানব তোমার জন্ম যে ধূলাতে তুমি আবার সেই ধূলাতেই একদিন মিশে যাবে’। এই জীবন নশ্বর-ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর পর যে জীবন রয়েছে সেটা-ই চিরস্থায়ী। সেই চিরস্থায়ী জীবনের নাম স্বর্গ ও নরক। আমরা এই পৃীথবীতে যে যেমন কাজ করবো পরকালে সেই মতোই বিচার পাবো। আর সেই অনুযায়ীই আমাদের অবস্থান হবে সেই স্বর্গ অথবা নরকে। আর সে কারণে পার্থিব জীবনে ত্যাগস্বীকার, প্রার্থনা দানশীলতা খুবই দরকার। মূলত ভষ্ম বুধবারের মধ্য দিয়েই সারা বিশ্বে কাথলিক খ্রীস্টমন্ডলী প্রয়শ্চিত্তকাল/ তপস্যাকাল অথবা আত্মশূদ্ধির কাল শুরু করে থাকে। দীর্ঘ চল্লিশ দিন নিজেদের প্রস্তুত করবে সকল খ্রীস্টভক্তগণ। পবিত্র বাইবেলের মার্ক রচিত সুসমাচারের ১ অধ্যায়ের ১৩ পদে উল্লেখ আছে যে ” যীশু চল্লিশ দিন মরু প্রান্তরে রইলেন। সেই সময় শয়তান তাকে যাচাই করার জন্য নানা প্রলোভনে ফেলতে চেষ্টা করল। ‌‌”উপবাস থাকার পর যখন তিনি শারিরিকভাবে দুর্বল তখনই শয়তান এলেন তাকে প্রলোভন দেখাতে। যীশু খ্রীস্ট ঈশ্বরের পুত্র হল্ওে তার মধ্যে মানবিক বিষয়্ও উপস্থিত ছিল। ৪০ দিন উপবাস করার তিনি যখন অনেক শারীরিকভাবে ক্ষুর্ধাত তখন শয়তান বুঝলেন এটাই উত্তম সময় প্রলোভনে ফেলার। কিন্তু যীশু সকল প্রলোভনই জয় করেছেন।

শয়তানের প্রলোভনের ৪টা দিক ছিল। প্রথমে সে যীশুকে দৈহিক খাদ্যের লোভ দেখিয়েছিল। তারপর ধন সম্পত্তি টাকা পয়সা তারপর প্রভাব রাজকীয়তার লোভ তারপর সে যীশুকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল আর প্রমান চাইল সে ঈশ্বরের পুত্র কীনা, এমন কি পবিত্র বাইবেলের প্রবক্তাদের ভবিষৎ বাণী নিয়েও চ্যালেঞ্জ করলো। কিন্তু যীশু সব প্রলোভনই জয় করেছেন। মূলত যীশু খ্রীষ্টের এই ৪০দিন উপবাস আর প্রার্থনার ফলশ্রুতিতেই আমরা সাড়া বিশ্বের কাথলিক খ্রীস্টানগন এই মার্চের ৬ তারিখ থেকে ৪০ দিন উপবাস, প্রার্থনা, ত্যাগস্বীকার করে থাকি। এই সংযমের, এই উপবাসের মূল শিক্ষা হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। অন্তঃকরণে পবিত্র হওয়া। উপবাস অথবা রোজা আমাদের সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। শুধু দৈহিকভাবে খাদ্য না খ্ওায়ার মধ্যে প্রকৃত অর্থে রোজা অথবা উপবাসের নিগুরতত্ব নিহিত নয়। উপবাসের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে প্রার্থনা করা, দান করা, পবিত্র জীবন যাপন করা, মানুষের উপকার করা, শত্রুকে ক্ষমা করা। এই বিষয়ে পবিত্র বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচের ৬ অধ্যায়ের ১৬ থেকে ১৮ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে ” তোমরা যখন উপোস করো তখন ভন্ডদের মতো বিষন্ন ভাব দেখিয়ো না। তারা যে উপোস করছে সেটা লোকদের দেখাবার জন্যই তারা মুখখানা অমন শুকনা করে রাখে। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি তাদের পুরষ্কার তারা পেয়েই গেছে। যখন তুমি উপোস করো তুমি বরং তখন মাথায় তেল মেখো, চোখ মুখ ধূয়ো। যাতে তুমি যে উপোস করছো মানুষ যেন তা জানতে না পারে, শুধু তোমার পিতা( ঈশ্বর) যিনি গোপনেই (অদৃশ্য) থাকেন। তাহলে তোমার পিতা যিনি গোপনে সব কিছু দেখতে পান তিনিই তোমাকে পুরষ্কৃত করবেন।”

লোক দেখানো উপবাস করা মানুষকে বলে বেড়ানো অথবা এমন ভাব করা কিংবা প্রকাশ্যে নিজের ভাল কিছু বলে বেড়ানো এই বিষয়েই তিনি সর্তক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বলেছেন ’তুমি যখন দান করো তখন তোমার ডান হাত যে কী করছে বাম হাত যেন তা জানতে না পারে।” অর্থাৎ দান করার ক্ষেত্রে আমরা যেন মানুষকে বলে না বেড়াই। আমাদের দান থাকবে গোপনে যা শুধু ঈশ্বর/সৃষ্টিকর্তাই দেখবেন ও জানবেন এবং তিনিই আমাদের পুরষ্কৃত করবেন। এবং আমাদের এই সকল পুরষ্কার সঞ্চিত থাকবে পরকালের জন্য।

এই চল্লিশ দিন উপবাস আর ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে আমরা খ্রীস্টানগণ স্মরণ করি প্রভু যীশুর (ইসলাম ধর্মের অনুসারীর মতে ইসা নবী) যাতনাভোগ আর কষ্টের কথা। আমরা ধ্যান করি তিনি এই জগৎ এ থাকাকালীন সময়ে যে বাণী প্রচার করেছেন, যে শিক্ষা দিয়েছেন যে সকল অলৌকিক কাজ করেছেন সব কিছুই। এই সময়টাতে মন্ডলী অতিরিক্ত আনন্দ উল্লাস, বিয়ে সাদি করা বা হওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা এই সময়ের মূল শিক্ষা কষ্ট করা, পাপ থেকে মন পরিবর্তন করা। ত্যাগস্বীকার করা। যেন সত্যিকার অর্থেই আমরা তার স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি।

চল্লিশ সংখ্যাটি বাইবেলের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সংখ্যা। যীশু মৃত্যুর পর ৪০ দিন এ জগতে থেকেছেন তারপর তিনি স্বর্গে আরোহণ করেছেন। এই প্রায়শ্চিত্তকালের ৪০ দিন টাকে ৭টি সপ্তাহে ভাগ করা হয়েছে। ভষ্ম বুধবারের মধ্য দিয়ে এই ৪০ দিন শুরু যা ৬ মার্চ শুরু হবে। এই সময়টা হবে শুধু ত্যাগস্বীকার করার জন্য। নিরামিষ খ্ওায়া অথবা মাংসাহার ত্যাগ করা, উপোস রাখা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সাতটি সপ্তাহের শেষ সপ্তাহটাকে বলা হয় সব চেয়ে পবিত্রতম সপ্তাহ। এই সপ্তাহে স্মরণ করা হয় যীশু খ্রীস্টের ক্রুশীয় মৃত্যুর কথা। শেষ শুক্রবারটাকে বলা হয় গুড ফ্রাইডে। এই দিন যীশু খ্রীস্টকে ক্রুশে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ঈশ্বরের পুত্র হয়্ওে তিনিঁ ক্রুশে প্রাণ ত্যাগ করে প্রমান করেছেন মানুষের প্রতি পিতা ঈশ্বরের ভালবাসার দৃষ্টান্ত। তিনি আমাদের পাপের পরিত্রাণের জন্যই মূলত ক্রুশে প্রাণ বিসর্জূন দিয়েছেন।

এপিল মাসের ১৯ তারিখ হবে সেই দিন যে দিন তিনি প্রাণ ত্যাগ করবেন। সারা বিশ্বে পালিত হবে গুড ফ্রাইডে। তার তিনদিন পরই পালিত হবে পুনরুথানকাল। অর্থাৎ তিনি মৃত্যুকে জয় করে পুনরুথান করবেন। তিনি আবার বেঁচে উঠবেন। তার এই পুনরুথানই হচ্ছে স্বর্গ আর নরকের সংযোগ। তিনি পুনরুথানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছেন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন। সেই জীবনই হবে অনন্ত জীবন। যে জীবনের জন্য আমরা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে ভাল ভাল কাজ করে সঞ্চিত করে রাখবো ধন সম্পদ। মূলতঃ এই তপস্যাকালেই মন্ডলী আমাদের সেই শিক্ষাই দিতে চান। আমাদের মৃত্যুর পর এই মাটির দেহটি এই নশ^র দেহটি যে ধূলায় মিশে যাবে সেই কথাই মূলত মন্ডলী ৬ মার্চে কপালে ভষ্ম লেপনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেন। মানুষের বিশ্বাসের এক চিরন্তণ সত্য নিগুরতত্ত্বটিই আমরা ধ্যান করি এই সময়ে। সেই দৃষ্টিকোন থেকে এই দিনের শিক্ষা অথবা নিগুরতত্ত্বটি সব শ্রেণীর , সব গোষ্ঠীর মানুষের জন্য সমান ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মৃত্যু যে আমাদের জীবনে কখন আসবে আমরা কেউ তা জানি না। সেজন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার জন্যই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া আমাদের এই ধূলির দেহ একদিন ধূলিতেই মিশে যাবে। কীসের অহংকার কিসের দাম্ভিকতা সব কিছুই একদিন পড়ে থাকবে। আমাদের সবাইকেই এই সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে। কোন শক্তিই আমাদের বেঁধে রাখতে পারবে না।

সুতরাং এই উপবাসকালে আমাদের সকলেরই প্রধান তপস্যা হচ্ছে হৃদয় ও আত্মায় শুদ্ধতা লাভ করা। মূলত এই সময়টিই আমাদের খ্রীস্টের সঠিক আদর্শ অনুসরণ করতে শিক্ষা দেয়। দেহ মন আত্মায় পরিশুদ্ধতা আনয়নের মধ্য দিয়েই আমদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণীত করে।