তাদের দিনপঞ্জি

কমলকলি

ঘরের বারান্দায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে জয়তুন; তারপর খানিকটা দ্রুত পায়েই নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। দরজা ভেজিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেছে, আজও সেই গা জ্বালানো দৃশ্য। জয়তুনেরই দেবর, একমাত্র দেবর, মওলা, তার থেকে দু’এক বছরের বড়ই হবে, উঠোনের ও পাশে কাঁঠাল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে জয়তুনের ঘরটার দিকেই। এ বাড়িতে নতুন বৌ হয়ে এসেছে জয়তুন ছ’মাসেরও বেশি সময়। সতর আঠারো বয়সের ছিপছিপে দীর্ঘায়ু চোখ জুড়োনো আদলের মেয়েটা পাল্কি থেকে নেমে আসার পর নতুন বৌকে দেখে, উপস্থিতরা খুশি হয়েছিল খুব।
জয়তুনের স্বামী মোশারফ, বড় বাজারে বড়সড় মুদির দোকান আছে নিজেরই। বাড়ির অবস্থাও সচ্ছল । দু ভাই তিন বোন। বোন তিনটির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আগেই। জয়তুনের শাশুড়ী বলছিল বছরখানেক যাক, ছোট ছেলে মওলারও বিয়ে দেবে। মেয়ে খুঁজতে বলেছে একে ওকে।
মওলারও আছে ছোটখাটো একটা ব্যবসা। ভাইয়ের বিয়ের আগে তার সাথে কনে দেখার জন্য জয়তুনদের বাড়িতে যেতে পারেনি কোন কারণে। তাই বিয়ের পরেই নতুন ভাবীকে এমনভাবে দেখছিল। পাল্কি থেকে নেমে আসার পরেও নতুন ভাবীকে অতটা ঠাহর করেনি। কিন্তু ভাইয়ের ঘরে যখন ফুলের মালায় সাজানো পালঙ্কে বসিয়ে মাথার ঘোমটা সরিয়ে সবাই জয়তুনকে দেখছিল, তখন মওলাও অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল নতুন ভাবীর মুখের দিকে।
অনেক সুন্দর মেয়ে দেখেছে সে এই গাঁ এবং আশেপাশের গাঁয়ে। কিন্তু জয়তুন ভাবীর মত সুন্দর যেন আর কাউকে দেখেনি। শুধু সৌন্দর্য নয়। আরো যেন কি আছে ভাবীর মুখাবয়বে, যেটা সবাইকেই খুব কাছে টানে। একটা বিস্ময় নিয়েই ভাবীকে দেখেছিল মওলা। কিসের একটা অমোঘ আকর্ষণে ভাবীর দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারে না। তারপর থেকেই তার মনের ভেতরটায় কি যেন হয়েছে। কিছু অন্যরকম কথার কানাকানি, ফিসফিসানি।
আর সেটা বুঝতে পেরেছিল জয়তুন কিছুদিন পরেই। মওলার লোভাতুর চোখের দৃষ্টি তার সহজাত নারীর ভাবনাতেই ধরা পড়েছিল। সেও কেমন যেন সঙ্কোচে থেকেছে। খানিকটা ভয়ও পেয়েছে। কিন্তু স্বামীকে কোন কথা বলতে পারেনি। চেষ্টা করেছে সহজ আর স্বাভাবিক থাকতে।
ছ’মাস গড়িয়ে গিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় বড় ঘরের ছড়ানো বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বাড়ির সবাই বসেছে। আজ তাড়াতাড়িই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়িতে ফিরে মোশাররফ। গতকাল ঢাকায় খুব গ-গোল হয়েছে। গাঁয়ের কে একজন ঢাকা থেকে আজ ভোরেই এসেছে। গতরাতে ঢাকা শহরে ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা গোলাবারুদ বোঝাই বড় বড় গাড়ি নামিয়েছিল ঢাকার রাস্তায়। বন্দুকের গুলিতে শত শত মানুষ মারা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর অবস্থা ভীষণ খারাপ।
হ্যাঁ, শুনেছিলাম তো শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশেই গত এক মাস ধরে অচলঅবস্থা চলছিল। আমরা গাঁ-গেরামে থাকি, এ রকম যে হবে এতটা বুঝি নাই। মাথা হেলিয়ে মোশারফের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা কথা কটি বলল।
ক্রমশ সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছিল। রাতের খাওয়াটা কোন রকমে খেয়ে নিয়েছিল বাড়ির সবাই। ঘুম নামেনি কারুর চোখেই। এক সময় স্ত্রীকে মোশারফ বলল, জয়তুন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছ এই গ-গোল সারাদেশেই ছড়িয়ে যাবে। ভাবছি।
কি ভাবছেন?
মাত্র বিয়ে শাদী করলাম, নতুন ঘর উঠালাম, ব্যবসা ভালই হচ্ছিল, কি যে হয়। জয়তুন বিছানার ওপরে উঠে বসে, ভয় পাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। না জানি, আমার বাপের বাড়ির মানুষেরা কি করছে। এই খবর তারা জানলো কিনা। বাপজানের শরীরটাও ভাল নেই। ভাই দুটি ছোট মা- তো।
একটা গাঢ় নিশ্বাস ছেড়ে আবারও বলল জয়তুন, খবর নিশ্চয়ই পেয়েছ। বিদ্যুতের মতই সারা দেশে ঢাকার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু খবর পৌঁছানো নয়, হানাদাররাও এ শহর ও শহরে সেই রাতের পরে ছড়িয়ে পড়েছে সশস্ত্র অবস্থায়। মাস দুয়েক চলে গেছে। এখন প্রায় দিনই মোশারফ সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে আসে। বাবা মা খুব অস্থির হয়ে থাকেন। মওলাকে বলে, ব্যবসার কাজে বেশি দূরে যাবি না। প্রতিদিনই সাধারণ মানুষের ওপর পাক হানাদারদের অত্যাচারের খবরে শিউরে ওঠে তারা। বাড়িতে গোপনে রেডিওতে খবর শোনে।
তবুও সংসারের কাজ তো পড়ে থাকে না। শাশুড়ির কাজে এটা ওটা এগিয়ে দিয়েছে জয়তুন। মওলাকে মাঝে মাঝে ভাত বেড়ে দিতে হয়েছে তাকে। সে আর শাশুড়ি ছাড়া মওলাকে ভাত বেড়ে দেয়ার মত বাড়িতে আর কেউ নেই । মওলার বিয়েটা হয়ে গেলে জয়তুনের স্বস্তি যেন। কিন্তু এখন দেশের এই অবস্থায় বিয়ে শাদীর কথা কেউ আর ভাবছে না। একজনকে খাবার খেতে দিয়েই তো সেখান থেকে সরে যাওয়া যায় না। জগত জুড়ে দেবর ভাবীর সম্পর্ক, সেতো বড় মধুর সম্পর্ক।
ভাত বেড়ে দেয় বড় কাঁসার থালায়। মাছ ডালের বাটি এগিয়ে দেয় জয়তুন। গরম পড়েছে। হাত পাখা ঘোরায় সে। মাছিরও উৎপাত আছে।
আমাকে দেখলে তুমি পালাই পালাই করো কেন ভাবী? আরে বসো না ভাল করে, দুটো কথা কই তোমার সাথে। আজকের মাছের তরকারীটা কে রেঁধেছে ভাবী? খুব ভাল হয়েছে।
মাথা নিচু করে উত্তর দেয় জয়তুন, আমি রেঁধেছি। তোমার রান্নাটা অন্যরকম। খাওয়ার পরেও মুখে স্বাদটা লেগে থাকে ভাবী। তারপর কি যেন ভেবে জয়তুন বলে, আচ্ছা, আপনি খান, আমি যাই দেখি আব্বার কিছু লাগবে কিনা। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
মওলার সামনে থেকে উঠে গিয়েছে জয়তুন। বুঝি পালিয়ে বেঁচেছে। কেমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বাটি ভর্তি মাছ, ডাল, তরকারি, গামলায় ভাত সামনেই সব সাজানো। কিন্তু সেও যেন আর খেতে পারে না। আর এক গ্রাস ভাত মুখে তুলতে ভুলে যায়। হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সপ্তাহ খানেক চলে গেছে। বড় বোনের দারুণ অসুস্থতার খবর আসে গাঁয়েরই একজনের মারফত। মা বাবা মওলাকে নরসিংদি পাঠিয়ে দিয়েছে। বড় বুবু বহুদিন ধরেই অসুস্থ। দেশের এই অবস্থা, রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভাল নয়। তবুও মওলা এ পথ ও পথ ভেঙে বোনের বাড়িতে গিয়েছে বোনকে দেখতে। গাঁয়ের বাড়িতে এখন শুধু বাবা মা, মোশাররফ, জয়তুন আর একজন কামলা আছে।
সেদিন সকালে দোকানে আর যেতে পারেনি মোশাররফ। ভোর রাতে দু ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে ঘিরে ফেলেছিল সমস্ত গ্রামটা। তারা খবর পেয়েছিল এই গ্রামে নাকি অনেক মুক্তি লুকিয়ে আছে।
বাঁশের দরজা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলে হানাদারদের চারজন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে সেই ভোরবেলাতেই। কামলা বাতেন মুখ হাত ধুয়ে মুরগীর খাবার উঠোনের এপাশে ছড়িয়ে খোঁয়াড় খুলে দিয়েছে। বাকী সবাই ঘুমিয়ে রয়েছে এখনো। ঠিক সেই মুহূর্তে হানাদাররা বন্দুক তাক করে বাতেনকে ঘিরে ফেলে। হঠাৎ তাদের দেখে বাতেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আওর আদমী কাঁহা হ্যায়? বলতে বলতে বন্দুকের ট্রিগারে একজন চাপ দিয়েছে। ওখানেই লুটিয়ে পড়ে বাতেন।
বন্দুকের গুলির শব্দ শুনেই হয়তো মোশাররফ দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ও ঘরের দরজা খুলেছে বাবা মাও। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। আর জেগে উঠে পালঙ্কের পেছনে লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে জয়তুন।
একটা গুলির শব্দ। মোশাররফের দিকে তাক করা বন্দুকটা এখনো। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। রক্তাক্ত দেহে মোশাররফ বারান্দাতেই লুটিয়ে পড়ে। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে হানাদার চারজন দুদ্দাড় করে চলে গেছে বাইরে। বাবা মা বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনো।
মওলা ফিরে এসেছিল সপ্তাহখানেক পরে। বিপর্যস্ত উস্কখুস্ক হয়ে গেছে চেহারা। সে সেখানে পৌঁছানোর দিন দুই পরে বড় বুবু দীর্ঘ দিন কালাজ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল। বাড়িতে ফিরে মওলা যেন স্থবির হয়ে গেছে। সময় চলে গেছে দ্রুতই। মধ্য ডিসেম্বরে বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল সমগ্র বাংলার মানুষ।
জয়তুন শ্বশুর বাড়িতেই রয়ে গেছে। তার বাবা তাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। শাশুড়ি ফিরে যেতে দেয়নি তার ছেলের বৌকে। সৎমায়ের সংসারে জয়তুনও ফিরতে চায়নি। কাঁচা বয়সের বৌ, অকাল বৈধর্ব এসেছে তার জীবনে। বাংলার হাজার হাজার মা মেয়ে বিধবা হয়েছিল। বাবা মায়ের শোকের সীমা ছিল না। বড় মেয়েটা ভুগে ভুগে দুটো সন্তান রখে দুনিয়া ছেড়ে গেল। মোশাররফও চলে গেল। সন্তান সম ছিল বাড়ির কামলা বাতেন, তারও হয়েছ অকাল যাত্রা। কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে বাবা মা।
মাঝখানে চলে গেছে দেড়টি বছর। জয়তুন শাশুড়ির সাথে সাথে থাকতো। রান্না বান্না করতো। বিষাদ প্রতিমার মত ঘুরে ঘুরে বাড়ির কাজগুলো করতো। মওলাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। ভাবীর দিকে আর ফিরে তাকাতো না। খাবারটা খেয়ে নীরবে উঠে যেত। একদিন শাশুড়ী জয়তুনকে কাছে ডেকে বলল, মারে জীবনটা কি করে কাটাবি? এই রূপ এই বয়স, আমরা মরে গেলে তোর ভার কে নেবে রে মা?
কি করবো মা, কোথায় যাবো? ডুকরে কেঁদে ওঠে জয়তুন। মোশাররফের স্মৃতি তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ির কি যেন ভাবলেন।
সেদিন বিকেলবেলা। জয়তুনকে কাছে বসিয়ে তার ঘন এক মাথা চুলে তেল দিয়ে, আঁচড়িয়ে বিনুনী করে দিয়েছেন শাশুড়ী। তারপর বললেন, মারে তোর জীবন তো এভাবে নষ্ট হত পারে না।
মা! শোন, আমরা ভাবছি মওলার সাথে তোর বিয়ে দেব। তুই আমার ঘরেই থাকবি। তোর মধ্যে যে অনেক মায়া রে মা। তোকে তো আমরা ছাড়তে পারবো না।
মা! বিস্ময় আর বেদনা নিয়ে তাকিয়ে দেখছে শাশুড়িকে জয়তুন। দুচোখ ছল ছল করে উঠেছে। জয়তুনের বাবার কাছে খবর পাঠানো হলো। বাবা আপত্তি করেন নি।
মওলা আর জয়তুনের বিয়ের পরে বেশ কতদিন চলে গেছে। একদিন দুপুরে মওলা তার কাজ থেকে ফিরেছে। খাবার সাজিয়ে স্বামীকে খেতে দিয়েছে জয়তুন। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে জয়তুন।
মুখে এক লোকমা ভাত তুলে মওলা বলল, তুমিত খেয়েছ? না, মুখ নত, করেই উত্তর দেয় বৌ। পরে খাবো, মায়ের সাথে। আজ না হয় আমার সাথে খাও, ইতস্তত করে মওলা বলল।
একঝলক স্বামীকে দেখেছে জয়তুন। তারপর তার থালাটা কাছে টেনে বলল, বেশ তো।
হিউস্টন।