বিশেষ প্রতিনিধি : বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সরকার যত সহজ করে বলছে, বিষয়টি আসলে ততটা সহজ নয়। তাকে ফেরত নিতে হলে সরকারকে আইনিভাবেই সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, তারেক রহমান তার দেশের জন্য ক্ষতিকর। এটাও নিশ্চিত করতে হবে, দেশে ফেরত নেওয়ার পর তাকে সর্বোচ্চ দণ্ড ফাঁসি দেওয়া হবে না। তারেক রহমানকে ফেরত নেওয়ার জন্য ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার পর সবকিছু বিবেচনা করে যদি ওই দেশের আদালত আদেশ দেন যে যত নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে তাকে ফেরত দেওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে, তাহলে ব্রিটেনের আদালত আদেশ দিলেই তাকে ফেরত নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সেটিও সহজ নয়। ওই ধরনের ব্যবস্থায় সরকার গেলেও তারেক রহমানও ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। অর্থাৎ তিনি দেশের আইনে দ-প্রাপ্ত হলেও তাকে চাইলেই সরকার ফেরত নিতে পারবে না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার শাস্তি হতে হবে। বাংলাদেশে আর কোনো আইনি ব্যবস্থা থাকবে না তাকে ফেরত নেওয়ার জন্য। তখনই ব্রিটেন সরকারের কাছে বাংলাদেশ সরকার আবেদন করলে ব্রিটেন সরকার বিষয়টি আমলে নেবে। এর আগে সরকার আবেদন করলেও ব্রিটেন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। প্রথমত, তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। তার জীবনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষা করা ব্রিটেন সরকারের দায়িত্ব। অন্যদিকে বর্তমানে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাজিদ জাভিদ। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে সহায়তা করতে ও তারেক রহমানকে ফেরত দিতে উদ্যোগ নেবেন, সেটা বিএনপির কেউ মনে করছেন না। তারা আশাবাদী, বাংলাদেশ সরকার যত ব্যবস্থাই নিক না কেন, তারেক রহমানকে দেশে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন না।
একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নতুন করে আবেদন করার আগেই তারেক রহমানের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সকল নথিপত্র দিয়ে এবং প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে চিঠি লেখা হবে। এর আগে একবার সরকার তারেককে ফেরানোর জন্য ব্রিটেন সরকারের কাছে সহায়তা চাইলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। ওই সময়ে প্রয়োজনীয় সব কর্তৃপক্ষকে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে জানিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণে ব্রিটেন সরকার তারেক রহমানের বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকলেও তারেক রহমানকে ফিরিয়ে নিতে ও এ জন্য কাজ করতে বাধা নেই। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী কাজ হবে। এ আইনে কিছু কিছু অপরাধীকে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও ফিরিয়ে আনা যায়। সেই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্ট দুই দেশের মধ্যেই (বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য) আছে। সেই আইনেই চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সরকার তারেক রহমানকে ফেরাতে পারবে না জেনেও চেষ্টা করছে। এখন খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিয়ে তারেক রহমানকে দেশে নিয়ে কারাগারে ভরতে চাইছে। সরকার মনে করেছিল, খালেদাকে কারাগারে নিলেই তাদের ঝামেলা শেষ। তারেক রহমান লন্ডনে বসেই সব করবেন, সেটা তারা চিন্তা করলেও ধারণায় ছিল না তারেক রহমান এতটা করবেন এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে করবেন।
সূত্র জানায়, তারেক রহমানকে ফেরত নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। তবে সেটি কোন পর্যায়ে, এটা প্রকাশ করা হয়নি সরকারের তরফে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে কোনো আলোচনা এখনো শুরু করতে পারেনি। অথচ প্রয়োজন হবে এই পর্যায়ে আলোচনার। সূত্র জানায়, ব্রিটেন এ বিষয়ে সরাসরি আলোচনা করবে না। যতক্ষণ না বিষয়টি ওই পর্যায়ে না নিতে পারছে সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান আইন ও বন্দিবিনিময় চুক্তি ইংল্যান্ডের না থাকায় তাকে বাংলাদেশ ফেরত চাইলেও নিতে পারবে না। কেউ কেউ বলছেন, সরকার বন্দিবিনিময় চুক্তি করতে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, তারেক রহমানকে ফেরত নিতে চাইলে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে যত মামলা আছে, ওই সব মামলার সকল নথিপত্র দিতে হবে। বাংলাদেশে যেসব মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় হয়েছে, সেসব মামলার নথিপত্রও দিতে হবে। মামলার রায়ের কপি দিতে হবে। মামলার আপিল চলাকালীন অবস্থাও লাগবে। এছাড়া মামলাগুলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও রায় থাকতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেও ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে না। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনি দুর্নীতি করেছেন। এছাড়া ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি আসামি। ওই মামলায়ও তার শাস্তি হতে হবে। আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করলে এবং সর্বোচ্চ আদালতে শাস্তি হলে ওই সব বিষয় জানিয়ে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবর আবেদন করতে হবে বাংলাদেশের তরফ থেকে। সব রায় ও নথি পর্যালোচনা করে সেই আবেদন বিবেচনা করবে ওই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি মনে করে যে তিনি একজন সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকা- করেছেন, তিনি ইংল্যান্ডের জন্যও বিপজ্জনক, তাহলেই তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ইংল্যান্ডের আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। আদালত তাকে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে সরকার। যদিও আদালত তারেক রহমানকে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিলে তিনি ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আপিলে যদি সিদ্ধান্ত হয় তারেক রহমানকে ফেরত যেতে হবে না, তাহলে সরকার তাকে ফেরত পাবে না। কিন্তু ওই দেশে তারেক রহমান যদি আপিল বিভাগে হেরে যান, তাহলেই কেবল তাকে ফেরত নিতে সরকার পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে।
সূত্র জানায়, তারেককে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় যাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হয়, সেই চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। চলতি বছরের তৃতীয়ার্ধে ওই মামলার রায় হবে। তবে সরকার চেষ্টা করছে নির্বাচনের আগেই যাতে ওই মামলার রায় হয়। তারেকের বিরুদ্ধে রায় গেলে সরকার দ্রুত তাকে ফেরানোর সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেবে।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, তারেক রহমানকে ফেরত নেওয়ার জন্য সরকার যতই চেষ্টা করুক, কখনো তা সফল হবে না। কারণ সরকার যে পথে হাঁটছে, সেটি ভুল। তারেক রহমানকে সন্ত্রাসী বানাতে চাইছে, গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত সেটাও বলতে চাইছে। এ জন্য ২১ আগস্টের মামলায় তার নাম না থাকলেও পরে যোগ করা হয়েছে। এখন ওই মামলার ভরসা করেই সরকার এগোচ্ছে। এর আগে সরকার সব নথিপত্র ও তারেক রহমানের নানা কথা বলে ইন্টারপোলের কাছে চিঠি পাঠায়। ইন্টারপোল সরকারের ও পুলিশের দেওয়া তথ্যকে বিশ্বাস করে ও ভিত্তি করে তারেক রহমানের নাম ইন্টারপোলের ওয়ানটেডের তালিকায় প্রকাশ করে ও নোটিশ করে। এরপর তারেক রহমানের আইনজীবী ও তার তরফ থেকে ইন্টারপোলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়। তারেক রহমানের পুরো জীবনকাহিনি, তার পরিচয়, তার অবস্থান ও তাকে যে ইচ্ছা করেই সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা চলছে, সেই ব্যাপারেও তথ্য দেয়। এছাড়া পুরো বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দেখা হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। রাজনৈতিক মামলার কথাও উল্লেখ করা হয়। ওয়ান ইলেভেনের সময় তার ওপর যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয় তুলে ধরে এবং তিনি যে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তাকে বিদেশে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য, তা-ও জানানো হয়। সেই সঙ্গে চিকিৎসকের নথিপত্রও তুলে ধরা হয়। এছাড়া গত আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান সরকার তারেক রহমানকে নিয়ে যে আচরণ করছে, হয়রানি করছে, আদালতের আদেশ থাকার পরও তাকে পলাতক ঘোষণা করায় সব মিলিয়ে তারেক রহমানের জীবন বাংলাদেশে নিরাপদ নয় ও তাকে নিয়ে গেলে তার চিকিৎসা ব্যাহত হবে, এসব তথ্য তুলে ধরা হয় ইন্টারপোলের কাছে। ইন্টারপোল তারেক রহমানের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র বিবেচনা করে পরে তার নাম ইন্টারপোলের তালিকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর সরকার নানাভাবে চেষ্টা করে তারেক রহমানের নাম ইন্টারপোলের তালিকায় দ্বিতীয়বারের মতো তোলার। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেছেন, তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর সুযোগ রয়েছে। কীভাবে সম্ভব তাও বলেছেন। তবে এত দিন সরকার আশা দেখলেও এখন তা কমে যাবে। কারণ, এখন বর্তমানে ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন সাজিদ জাভিদ। তিনি ছোটবেলায় পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। তার বাবা বাসচালক ছিলেন। এরপরও তিনি চাকরিও করেছেন। সাজিদ জাভিদ সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। ২০১০ সালে ব্রোমসগ্রোভ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি কমিউনিটিস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন দেড় বছর। তার বর্তমান বয়স ৪৮ বছর। তিনি সরকারের বাণিজ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১৭ সালে লন্ডনে গ্রেনফেল টাওয়ার অগ্নিকা-ের সময় সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান সরকারের ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। এটা ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও অজানা নয়। বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বৈরী নয়। তারেক রহমান তার পুত্র। সে কারণেও আওয়ামী লীগকে সহায়তা করতে তারেক রহমানকে ফেরত দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন কি না সন্দেহ রয়েছে।