তিমির অবগুণ্ঠনে পৃথিবীর মাহসা আমিনিরা

তামান্না ঝুমু :

আমি বাংলাদেশে থাকাকালে একবার আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দেশে বেড়াতে যান। তখন তারা আমার বাবার বাড়িতেও এসেছিলেন নেমন্তন্ন খেতে। আমাদের বাড়িতে তখন আমার শহরবাসী কাকা-কাকি এবং আরো অনেক আত্মীয়স্বজনের সমারোহ। আমি অতিথি-আপ্যায়নে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখলাম, আমার শাশুড়ি শাহাজান বেগম আমার এক আত্মীয়ার কানে কানে কিছু বলছেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই আত্মীয়া আমাকে বললেন, ‘ঝুমু, তোমার শাশুড়ি তোমাকে মাথায় ঘোমটা পরতে বলছেন।’ ভরা মজলিসে ওই কথাটি আমার কানে দোররার মতো শপাং শপাং বাজল। আমার খুশি মন মুহূর্তে বিমর্ষ হয়ে গেল। তবু আমি একান্ত বাধ্য বউয়ের মতো টুপ করে ঘোমটা পরে ফেললাম। তার পরও আমার শাশুড়ি আমার দিকে অনেকক্ষণ বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। আমার এক কাকি, মণিকাকি, বললেন, ‘বেয়ান, ঘোমটা আসলে এমন ব্যাপার, যা মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে গেলে আপনাতেই মাথায় উঠে আসে, আর বাবার বাড়িতে এলে আপনাতেই খসে পড়ে।’ কিন্তু আমার কাকির বেয়ান এমন সহজ কথা সহজে মেনে নেওয়ার পাত্রী নন। তিনি বজ্রকণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘এসব বেলেল্লাপনা আমি মানব না। বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়িই শুধু নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো সময়ই বউয়ের মাথায় ঘোমটা থাকতে হবে এবং এমনভাবে থাকতে হবে, যাতে একটা চুলও কেউ দেখতে না পায়। মাথা বা চুল দেখা গেলে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না।’

আমাদের বাড়িতে আমার কাকিদের সাজপোশাকে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কাকিরা তাদের শ্বশুরবাড়িতে উন্মুক্ত মাথার মুক্ত চুলে মনের আনন্দে হাসিখুশি পরিবেশে ঘুরে বেড়াতেন। আর সেই বাড়িতেই আমার মাথা ও মাথাস্থিত চুল সারাক্ষণ ঢেকে অস্তিত্বহীন করে রাখতে হবে! আমার মানতে কষ্ট হলো। আমার স্বামীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার মাথায় ঘোমটা ছিল না। মাথায় ঘোমটা তো দূরের কথা, গায়ে কোনো গামছা পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু আমার শাশুড়ি-মা নিজের পুত্রের এমন বেপর্দা ও বেলেল্লাপনা দেখেও তাকে জামা পরতে বা ঘোমটা দিতে বললেন না। শাশুড়ি-মায়ের তার পুত্রের প্রতি এহেন অসমতা মানতে আরো কষ্ট হলো আমার। কেন, আমার বরের মাথা ও চুলের কি কোনো মূল্য নেই? ওসব কেন ঢেকে রাখা জরুরি মনে করলেন না শাশুড়ি-মা? কিন্তু মুখে তখন এখনকার মতো ভাষা ছিল না। চুপ করে, মাথায় এক হাত ঘোমটা টেনে পুনরায় কাজে ব্যাপৃত হয়ে গেলাম।

আরেকবার আমার মাথায় ঘোমটা থাকা সত্ত্বেও শাশুড়ি দৌড়ে এসে আমার দিকে মিলিটারির দৃষ্টি দিয়ে গণনা করতে শুরু করলেন, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়! ভয়ে আমার বুক দুরু দুরু করতে লাগল। কী জানি, কী অপরাধ করে ফেলেছি নিজের অজান্তে! গণনা থামিয়ে শাশুড়ি বললেন, ‘এই যে, তোমার মাথার ছয়টা চুল দেখতে পাচ্ছি। আর তোমার গলারও আধা ইঞ্চির মতো দেখা যাচ্ছে। ভালো করে মাথার চুল ঢাকো, গলা ঢাকো। চুল আর গলা কেন দেখা যায়? এসব নষ্টামি এখানে চলবে না।’ আমি ভালো করে আমার চুল ও গলা পৃথিবীর কাছ থেকে ঢেকে একেবারে গোপন করে ফেললাম। দেখলাম, আমার শ্বশুর হাজি মফিজুর রহমান অদূরে দাঁড়িয়ে; খোলা চুল, খোলা মাথা, খোলা গ্রীবায়! শাশুড়ির কাছে তার স্বামীর মাথার চুল ও গ্রীবার কোনো মূল্য নেই দেখে বড় অবাক হলাম।

আমি বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার পথে রওনা হওয়ার আগে আমার শাশুড়ি বারবার ফোনে একটি কথাই আমাকে বললেন, ‘খবরদার! যাত্রাপথে মাথার ঘোমটা যেন কিছুতেই আলগা না হয়, একটা চুলও যেন কেউ কিছুতেই না দেখতে পায়, গলার নমুনাও যেন কেউ টের না পায়।’ তার আদেশমতো আমি বিমানের ভেতরে নিজেকে পুরো একটা পুঁটলির মতো আপাদমস্তক বেঁধে একটি সিটে ফেলে রাখলাম। সেই পুঁটলি আমাকে আমার শাশুড়ি বিমানবন্দরে প্রথম দর্শনে অভ্যর্থনায় বললেন, ‘তোমার গ্রীবা দেখা যাচ্ছে, গ্রীবা ভালো করে ঢাকো।’ কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই শাশুড়ির পুত্র ও স্বামীর চুল, মাথা ও গ্রীবা একেবারে হাট করে খোলা দেখলাম। আমি তখন মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, আমাকে ওই পুঁটলি অবস্থায় যেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছাড়া আমার আর কোনো আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত কেউ না দেখে। কারণ ওই শোচনীয় করুণ অবস্থায় কেউ আমাকে দেখলে আমার মান-সম্মান থাকবে না।

আমেরিকায় শ্বশুরবাড়িতে এসে বাস করতে শুরু করলাম। আর আমার সর্বাঙ্গে সর্বক্ষণ সর্বদিক থেকে বাঁশ চালিত হতে লাগল। আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমার বাইরে বের হওয়া বারণ। ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলা বারণ। বই পড়া বারণ। গান শোনা বারণ। টিভি দেখা বারণ। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখা বারণ। বরের সঙ্গে কথা বলাও বারণ। কারও সঙ্গে মুখে মুখে কথা বলা বারণ। ভোর পাঁচটা থেকে রাত একটা অবধি শুধু কাজ, অভিযোগ, গালিগালাজ আর মারদাঙ্গা। এমন অনেকবার হয়েছে, সারা দিন কাজ করে মাঝরাতে আমি ক্লান্ত দেহে ঘুমাতে গেছি, সেই সময়ে আমার শাশুড়ি আমার মাথার ঘোমটা ঠিক আছে কি না বা আমি টিভি দেখছি কি না, তা সরেজমিনে তদন্ত করতে আমাদের শয়নকক্ষে ঢুকেছেন। তার পুত্রকে বলেছেন, ‘খবরদার! খেয়াল রাখবি, যাতে ঘুমের মধ্যেও বউয়ের মাথার চুল না দেখা যায়। ঘুমের মধ্যে চুল ঢাকা না থাকলে চুলের ভেতরে শয়তান ঢুকে যাবে। বউকে কখনো টিভি দেখতে দিবি না, বাইরে বের হতে দিবি না। টিভি দেখলে, বাইরে গেলে ও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ অথচ আমার শাশুড়ি, তার স্বামী, পুত্র ও কন্যারা টিভি দেখতেন, বাইরে যেতেন এবং ফোনে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেন। এসব শুধু আমার জন্য হারাম ছিল। কারণ ওসব হারাম বস্তুর সংস্পর্শে আমি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাব।

কয়েকবার আমাকে মানুষের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাকে বাড়ি থেকে বের করার আগে ভালোভাবে বোরকা পরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বোরকা পরলে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। আমার খুব অস্থির লাগত। আপাদমস্তক যথেষ্ট পরিমাণে কাপড়ে ঢাকার পর এ রকম ভয়াবহ একটা আজব জিনিসে সমস্ত কাপড়চোপড় কেন ঢেকে দিতে হবে? আমি যতবার বোরকা পরতে বাধ্য হয়েছি, ততবার নিপীড়িত বোধ করেছি, অসহায় বোধ করেছি, নির্যাতিত বোধ করেছি, বন্দী বোধ করেছি, অপমানিত বোধ করেছি, ক্ষুদ্র বোধ করেছি। বোধ করেছি, বোরকা নারীর সম্মান নয়, চরম অপমান। বোরকা মনুষ্যত্বের অপমান। মানুষের কাছে নিরাপত্তা বা সম্মান অর্জনের জন্য এ রকম একটি অদ্ভুত জিনিস দিয়ে কেন কাপড়চোপড় গোপন করে ফেলতে হবে? আমেরিকায় কালো প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে মানুষ ময়লা ফেলে। ময়লার বস্তা লোকে নির্দিষ্ট দিনে নিজ নিজ বাড়ির সামনের ফুটপাতে স্তূপ দিয়ে রেখে দেয়। স্যানিটেশনের ট্রাক এসে ওগুলো তুলে নিয়ে যায়। বোরকা নামক বস্তুটি পরার পর আমার নিজেকে ময়লার বস্তা মনে হতো। বোরকা নারীকে তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখায়, নিজেকে অসম্মান করতে শেখায়। নিজেকে ব্যক্তি নয়, বস্তু ভাবতে শেখায়।

একদিন রান্নাঘরে আমি রান্না করছিলাম। আমার শাশুড়ি তার শয়নকক্ষে। বাসায় আর কেউ ছিল না। রান্নাঘরে আমি একা রন্ধনরত। আমার শ্বশুর হাজি মফিজুর রহমান বাইরে থেকে হঠাৎ বাসায় এলেন এবং রান্নাঘরের পাশ দিয়ে তাদের শয়নকক্ষের দিকে যাওয়ার সময় আমাকে নানা চ-বর্গীয় শব্দে বেশ সাবলীলভাবে গালি দিতে লাগলেন। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, আমাকে কেন গালি দেওয়া হচ্ছিল। পরে বুঝতে পারলাম, আমার ঘোমটা নাকি সহিভাবে দেওয়া ছিল না, যে কারণে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে হাজি শ্বশুর সাহেব আমার মাথার কয়েকটি চুল দেখতে পেয়েছিলেন। কিছুক্ষণ আমার শ্বশুর হাজি মফিজুর রহমান আমাকে একা একা গালি দেওয়ার পর আমার শাশুড়ি হাজি শাহাজান বেগমও এসে তার স্বামীর সঙ্গে যোগ দিয়ে দ্বৈত কণ্ঠে আমাকে গালি দিতে লাগলেন। পরে আমার ননাস শাহীন আক্তারও এসে যোগ দিলেন। বললেন, ‘ঠিকই আছে। ঘোমটা সহি ছিল না তোমার!’ পরবর্তী কয়েক দিন টানা গালিগালাজ চলল তাণ্ডব-সহযোগে। অতঃপর লোকজন ডেকে আমার বিরুদ্ধে সালিস বসানো হলো। সালিসে আমার বিরুদ্ধে আমার শ্বশুরের অভিযোগ ছিল, ‘সেদিন মানাতান (ম্যানহাটন) থেকে বাসায় ফিরে দেখি, এই ভিক্ষুকের মেয়ের মাথার চুল দেখা যাচ্ছে। এটাকে আমার বাসায় আর রাখব না। এটাকে এই মুহূর্তে তালাক দেওয়াব এবং লাথি মেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেব।’ সালিসদাররা সবাই বললেন, বউয়ের মাথার চুল দেখা যাওয়া তো অনেক বড় অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আমরা সবাই তো খুব দয়ালু, তাই এই যাত্রায় ওকে মাফ করে দিয়ে ভালো হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলাম! দুঃখের বিষয় হলো, আমার হাজি শ্বশুর, বর ও সালিসদার কারও মাথাতেই তখন ঘোমটা ছিল না।

আমার ননাস শাহীন আক্তার বলতেন, ‘কখনো তোর মাথা দেখা গেলে, মাথার একটা চুল দেখা গেলে মাথা কেটে ফেলব, বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলব। কখনো আমাদের কারো মুখে মুখে তর্ক করার চেষ্টা করলে তোর মুখের ভেতরে জুতা ঢুকিয়ে দেব।’ শাহীন এসব কথা আমার বরের সামনেই বীরদর্পে বলতেন। আমি ভয়ে টুঁ-শব্দটি করতাম না। দু-একটি কথার মৃদু প্রতিবাদ করতে চাইলেও ওরা আমাকে মারত। আমার কিঞ্চিৎ মাথার চুল বা গ্রীবা দেখা গেলেই আমার শ্বশুর হাজি মফিজুর রহমান, শাশুড়ি হাজি শাহাজান বেগম ও ননাস শাহীন আক্তার একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে তাণ্ডব শুরু করতেন। আমার চুল আর গ্রীবায় এমন কী আশ্চর্য জিনিস আছে, ভেবে থৈ পেতাম না। পরে বুঝলাম, আমার মাথা আছে, তার ভেতরে মগজ আছে। আমার মগজের বুদ্ধি বিকশিত হয়ে পড়লে ওদের বিপদ হবে। আমার মাথার উপরের চুলের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়লে ওরা হিংসায় জ্বলবে। আমার গ্রীবা আছে। গ্রীবার ভেতরে কণ্ঠ আছে। সে কণ্ঠ সচেতন হয়ে আওয়াজ তুলতে শুরু করলে ওরা বিপদে পড়বে। আমার গ্রীবার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়লে ওরা ঈর্ষায় জ্বলবে। তাই আমার মাথা, মগজ, চুল ও গ্রীবায় ওদের এত ভয়। তাই আমারই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ওরা সাবধানে বস্তাবন্দী করে রাখত। ওরা অনেক দূরদর্শী।