তামান্না ঝুমু :
একদিন কাপিল শর্মার কৌতুক অনুষ্ঠানটি দেখছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে মুক্তি মোহন এসেছিল অতিথি হিসেবে। মুক্তি মোহন একজন ভারতীয় কৌতুক-অভিনেত্রী, অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী। মুক্তিকে কাপিল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মুক্তি, বিয়ের পর যদি তোমার বর তোমাকে অভিনয় ও নৃত্য ছেড়ে দিতে বলে, তুমি কী করবে?’ মুক্তি একমুহূর্তও না ভেবে দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি তাকে বলব, তুই মরে যা।’
নৃত্য ও অভিনয় শিল্পের দুটি শাখা। শিল্পের প্রতি হৃদয়ে অনেক ভালোবাসা এবং শিল্পী হওয়ার জন্য অবিরাম নিরলস সাধনা ও অধ্যবসায়ে একজন মানুষ একটু একটু করে শিল্পী হয়ে উঠতে পারে। অনেক দিনের কঠিন পরিশ্রম ও সাধনায় মুক্তি আজ একজন নৃত্য ও অভিনয়শিল্পী হতে পেরেছে। কারো হাস্যকর ও অন্যায় দাবিতে মুক্তি তার এমন একটি শখ ও অর্জনের জলাঞ্জলি কেন দেবে? কোনো মানুষের এমন একটি কষ্টের অর্জন অন্য কারো অন্যায় দাবিতে বিসর্জন দিতে হবেই কেন? শুধু শিল্পই নয়, অন্য যেকোনো শখ বা অর্জন বা অর্জনের চেষ্টাই ক্ষুদ্র নয়। যার যার কাছে, তার তার শখ স্বপ্নÑএসব বড় জিনিস। কিন্তু আমাদের সমাজে অগণিত মেয়ের স্বপ্ন যখন চোখ থেকে মুছে দেওয়া হয়, বুক থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়, আমরা কজন মেয়ে সেসব দুর্বৃত্তের উদ্দেশে নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে উচ্চারণ করতে পারি, তুই মরে যা?
আমাদের স্কুলে শাহেদা নামের একটি মেয়ে ছিল। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাহেদা গান গাইত। ও জীবনে কোনো দিন গান শেখেনি কারো কাছে। শুধু রেডিও এবং ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনে শুনেই নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েছিল নির্ভুল উচ্চারণ ও সুর। শাহেদা গাইত : পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়…, ওই মালতীলতা দোলে…, আমি এক যাযাবর… আর আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। আমরা বেশির ভাগই স্কুলজীবনে কোনো দিন কোনো অনুষ্ঠানে মাইকের সামনে দাঁড়াতে পারিনি লজ্জা, ভয় ও সংকোচে। আজ অবধি আমি মাইকে কথা বলতে পারি না। বড় সংকোচ হয়। কিন্তু শাহেদা এ ক্ষেত্রে ছিল অকুতোভয়, কুণ্ঠাবিহীন। মাইক মুখে নিয়ে, স্যারদের সামনে, শত শত দর্শক-শ্রোতার সামনে ও সুরের মূর্ছনা ছড়াত। অনেক বছর পার হয়ে গেছে আজ। জীবন গিয়েছে চলে, আমাদের অনেক অনেক বছর পার। আজও আমার কানে শাহেদার গান ভাসে। ওর জড়তাবিহীন মুখচ্ছবি ভাসে আমার চোখে।
কয়েক বছর আগে আমাদের স্কুলের একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। শাহেদার খবর ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, শাহেদা এখনো গান করে তো? ও বলল, ‘না রে, বিয়ের পর শাহেদা গান ছেড়ে দিয়েছে।’ দুঃসংবাদটি শুনে বড় কষ্ট হয়েছিল। ইচ্ছা করেছিল প্রবল, একটি তানপুরা শাহেদার হাতে দিয়ে ওর হাত ধরে বলি, তুমি গাও, শাহেদা! তুমি গেয়ে যাও! আমার মিনতি তোমার প্রতি, কোনো দিন তুমি তোমার গান আর সুরকে থেমে যেতে দিয়ো না। বিয়ের পরে শাহেদাকে গান ছেড়ে দিতে হয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকেদের খুশি করার জন্য। শাহেদার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একটি সুমধুর কণ্ঠ থামিয়ে দিয়েছে, একজন শিল্পীকে হত্যা করেছে। অনেক দিনের সাধনার একটি দুর্লভ অর্জনকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হকের ছোট ভাই সৈয়দ রইসুল হক জার্মানির কোলন শহরে আর্ট পড়তেন। একদিন সন্ধ্যায় ম্যাকডোনাল্ডে বার্গার খেতে গিয়েছিলেন। বেসমেন্টে নেমেছিলেন বাথরুমে যাওয়ার জন্য। সেখানেই খুন হয়ে গিয়েছিলেন এক দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে। ফজলে লোহানী লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে সৈয়দ শামসুল হক বিমূঢ় বেদনায় বলেছিলেন, ‘ক্যানভাসের কাছে আমার ভাইয়ের আর না-ফেরা, আর লোহানী সাহেবের সাহিত্যে না-ফেরা আলাদা করতে পারি না কিছুতেই।’ আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শাহেদার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বন্ধ করেছে ওর গান। আমার উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে না পারার বেদনা আর শাহেদার গান গাইতে না পারার বেদনা আমি আলাদা করতে পারি না। দুটি সাধ আর স্বপ্নের অপঘাতে অকালমৃত্যু আমাকে আজো হু হু করে কাঁদায়। যে-মেয়ে একদিন গাইত :
বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন
আমার রয়েছে পণ।
রঙের খনি যেখানে দেখেছি
রাঙিয়ে নিয়েছি মন।
আমি দেখেছি অনেক গোলাপ-বকুল
ফুটে আছে থরে থরে। আবার দেখেছি না-ফোটা ফুলের কলিরা
ঝরে গেছে অনাদরে।
সে-মেয়ে আজ আর গাইছে না। তার কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যে-মেয়ে উদাত্তকণ্ঠে গাইত : মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছি। সে-কুণ্ঠাবিহীন মেয়েটি নিজের প্রয়োজনের সময় কণ্ঠবিহীন হয়ে পড়েছিল। আরেকটি রুক্ষ চুলের পুঁচকে মেয়ে পথের ধুলো উড়িয়ে নগ্নপায়ে স্কুলে যেত। লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী ছিল না। ক্লাসে বসে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকত আর বড় হয়ে বড় বড় ডিগ্রিলাভের দিবাস্বপ্ন দেখত। তবু পরীক্ষায় কেমন অলৌকিকভাবেই যেন ভালো নাম্বার পেয়ে যেত, শুধু অঙ্ক ছাড়া। সেই মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওর স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করেছে। সেই মেয়েটি আমি। আমিও আমার প্রয়োজনের সময় বাকরহিত ছিলাম। আমাদের সমাজ ও পরিবার আমাদেরকে এভাবে আত্মঘাতী করে তৈরি করে। শাহেদার সুর থামিয়ে দেওয়ার বেদনা আর আমার পড়া থামিয়ে দেওয়ার বেদনা একই সুরে বাঁধা, একই রকম কষ্টের আমার কাছে।
আরেকটি পরিচিত মেয়ে গান গাইত সুন্দর। ওর বাবা-মা অনেক শখ করে ওকে গান শিখিয়েছিল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হলো, বিয়ের আগে গান গেয়েছ, এটাই ঢের, বাপু। আমাদের বাড়িতে ওসব আর চলবে না। ব্যস, তাতেই থেমে গেল একটি গানের গলা, অনেক বছরের সাধনা আর কষ্টে তৈরি একটি কণ্ঠ। মরে গেল একটি সাধ, একটি শখ। যারা তার গান থামিয়ে দিয়েছিল, তাদেরও বলতে পারেনি, তুই বা তোরা মরে যা, আমি গান ছাড়ব না। যে রকম বলতে পারিনি শাহেদা এবং আমি।
আমাদের গ্রামের একটি মেয়ে, শ্বশুরবাড়িতে কোনো সমস্যা নিয়ে যার সালিস বসেছিল গ্রামে। মেয়েটি সালিসে বারবার বলছিল, ওরা আমার পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাতে নিশ্চুপ। কিন্তু বিচারক বলছিলেন, ‘তুই পড়ালেখা করে এমন কোন আসমানে উঠবি?’ গ্রামের একটি নিম্নবিত্ত এবং প্রায় নিরক্ষর পরিবারের মেয়ে ছিল ও। কীভাবে বিচারসভায় নির্ভয়ে মাথা উঁচিয়ে বারবার উচ্চারণ করছিল ও একাই, ‘ওরা আমার পড়া বন্ধ করেছে। আমি পড়তে চাই। আমি পড়ব।’ ভাবলে অবাক বিস্ময় জাগে। সেই নাম-না-জানা দুঃসাহসী মেয়েটির প্রতি আমার প্রাণের স্যালুট। এমনটা এমনভাবে আমি পারিনি।
আমাদের সমাজের অনেক মেয়েকেই বিয়ের পরে নিজের সাধ-আহ্লাদ-শখ বিসর্জন দিতে হয়। আমাদেরকে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ, এমনকি শ্বশুরবাড়ির ধুলোবালিরও মনোরঞ্জন করতে হয়। রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, খাবার পরিবেশন করা, কারো পা টিপে দেওয়া, কারো মাথা টিপে দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা ইত্যাদি ইত্যাদি সব আমাদেরই করতে হবে। আমরা একাধারে ধোপা, নাপিত, বাবুর্চি, বয়Ñসবকিছু। ওদের সর্বপ্রকারের বিনোদনের ব্যবস্থা আমাদেরকেই করতে হবে। দিন শেষে আমাদের নিজের কোনো বিনোদন নেই। চুল আঁচড়ানোর সময়টুকুও নেই। আমরা নিজেদের সাধ-আহ্লাদ-স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে শ্বশুরবাড়ির সর্বস্তরের প্রাণিজগতের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাসে পরিণত হতে বাধ্য হই। আর তাতে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন ও সমাজ খুব গর্বিত ও আনন্দিতবোধ করে আমাদের নিয়ে। ঘরে ঘরে আমাদের বেশ প্রশংসা হতে থাকে; অমুকের মেয়ে গান, পড়ালেখা, এমন ভালো চাকরি সব ছেড়ে দিয়ে এখন সার্বক্ষণিক শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করছে, বরের কথামতো চলছে, কী সুন্দর বাপ-মার মুখ উজ্জ্বল করছে! আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়া হলে সমাজ খুশি, আমরা ক্রীতদাসে পরিণত হলে সমাজ খুশি। সমাজের শিক্ষাতেই আমরা সবাইকে খুশি করে চলি, শুধু নিজেকে ছাড়া। স্বপ্ন-সাধভাঙা বেদনা আমরা চাপা দিয়ে রাখি, তাও সমাজেরই শিক্ষায়। কিন্তু আমরা আমাদের স্বপ্ন, সাধ ও শখের হন্তারকদের মুক্তি মোহনের মতো বলতে পারি না, তুই/তোরা মরে যা। কারণ আমাদের সমাজ আমাদের মেয়েদেরকে আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস হওয়াকে গৌরবের ও পুণ্যের মনে করতে শেখায়। যারা আমার স্বপ্নকে, শখকে হত্যা করতে চায়, তাদের ‘তুই/তোরা মরে যা’ কথাটি আমার চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে বলতে শেখার প্রয়োজন ছিল। সময়মতো যদি বলতে পারতাম, আজ আমার জীবন ও জীবনের ইতিহাস অন্য রকম হতো। অতি প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস আমরা অনেক দেরিতে, অনেক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরে শেখার সুযোগ পাই। যেসব মেয়ে মুক্তি মোহনের সেই অনুষ্ঠানটি দেখেছেন বা আমার এই লেখার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, তারা নিজেদের প্রয়োজনের সময় উচ্চকণ্ঠে আপনার প্রতিপক্ষকে বলুন, ‘তুই/তোরা মরে যা।’ যে বা যারা আপনাদের স্বপ্ন ও সাধকে হত্যা করতে চায়, তাদের বলুন, ‘তুই/তোরা মরে যা।’