তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী!

মোহীত উল আলম

ভাগ্নে প্রকৌশলী হোসেন তৌহিদুল আলমের টয়োটা র‌্যাভ ফোর এস ইউ ভি গাড়িটা মেরিল্যান্ড থেকে ভার্জিনিয়ার পথে ধেয়ে চলেছে। রাস্তার দু’দিকে সারিবেঁধে ন্যাড়া পাইন গাছের বন। যুক্তরাষ্ট্রে বসন্ত ঢুকেছে আনুষ্ঠানিকভাবে, কিন্তু শীত রয়ে গেছে, গাছে পাতা এখনও পুরোপুরি গজায়নি। ড্যাশবোর্ডের রেডিওতে বাজছে, “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে” গানটি। কানে এল, “নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে।” তাইতো, ৭০/৮০ মাইল গতিতে চলছে গাড়িটি। উল্টে পড়লেই তো শেষ।
রবীন্দ্রনাথকে এভাবে দেখা যায়। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে বিপদের সময় তাঁর কাছ থেকে যেন একটা সমাধান পাওয়া যায়। সারা আমেরিকা ঘুরে দেখলাম বাংলাদেশীদের গাড়িতে গান বাজতেই বাজে রবীন্দ্র সঙ্গীত, অনুষ্ঠানে গান গাইতেই গায় রবীন্দ্র সঙ্গীত। “তাতা থৈ থৈ” গানটি আপাতদৃষ্টিতে লঘুছন্দের একটি গান, কিন্তু জীবনের বৈপরীত্য নিয়ে আমাদের অবস্থান–রবীন্দনাথ এ গানে এবং আরা প্রচুর গানে কত সুরেই না বলে গেছেন কান্না-হাসির সহাবস্থানের কথা।
তার চেয়েও ওপরের স্তরের দর্শন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক। ব্যক্তিমানুষের আর্তি–“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।” আবার আরেকটি গানে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ হারানোর ভয় থেকে কেঁদে উঠছেন, “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?” বলছেন, “কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।”
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভাষী কবি ও মনীষী। সকল বিচারে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি তিনি। আমাদের বাংলাদেশের ভাষাও বাংলা। তাঁর মতো ঐতিহ্যের প্রতি উদাসীন থাকা আমাদের জন্য আত্মঘাতস্বরূপ। তাঁকে উপেক্ষা করা হচ্ছে আমার মাতৃভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিকে উপেক্ষা করা। একটা অন্য প্রসঙ্গ এনে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়। তারপর তাদের একটা প্রচেষ্টা থাকে সবকিছুর মধ্যে আমেরিকানরা যে ব্রিটিশ থেকে আলাদা সেটা কাজে কর্মে চিন্তায় ও ব্যবহারে প্রতিফলিত করা। ইংলান্ডের ‘ফুটপাত’, আমেরিকায় হয়ে গেল, ‘পেইভমেন্ট’–এটা একটা সহজ উদাহরণ, আর যুক্তরাষ্ট্রে সকল বিদ্যুতের সুইচের ফলা নিচে থেকে উপরে ঠেলে দিতে হয় এটা হলো একটা ব্যবহারিক উদাহরণ, আর গাড়ি রাস্তার ডান দিকে চলে এটা হলো ভ্রমণের উদাহরণ। কিন্তু শেক্সপিয়ার? না, এ ব্যাপারে আমেরিকানরা নি:শঙ্ক। শেক্সপিয়ার তাদেরও ঐতিহ্য। কারণ তাদের ভাষাও ইংরেজি। শেক্সপিয়ারের ওপর বড় বড় গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার (হান্টিংটন, ফোলগার প্রভৃতি) আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাটসহ সমসাময়িক শেক্সপিয়ারের বড় বড় পন্ডিতেরা সবাই আমেরিকার বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে পড়াচ্ছেন। কোথাও দেখিনি যে আমেরিকানরা বলছে, হুইটম্যান বা ফ্রস্ট শেক্সপিয়ারের চেয়েও প্রাগ্রাধিকার পাবে তাদের সমাজে।
ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারের যে অবস্থান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানও বাংলা সাহিত্যে তাই। তাই ইংল্যান্ড থেকে স্বাধীন হয়েও যদি আমেরিকায় শেক্সপিয়ার সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়ে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন আমাদের সমাজে হবেন না। বাধা কী? কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন, শেক্সপিয়ার আমেরিকায় গৃহীত হয়েছেন কারণ তিনিও খ্রিস্টান। একই ধর্ম, সে জন্য অসুবিধে হয় নি। আমেরিকায় শেক্সপিয়ারের ক্ষেত্রে ভাষা এবং ধর্ম দু’টোই সহযোগিতা দিয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে গৃহীত হবার প্রাক্কালে–অষ্টম সংশোধনীর আলোকে বলতে হয়–ভাষা সহযোগী, ধর্ম অসহযোগী। কিন্তু এ কথাটা বলার অর্থ হলো রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িকতার ঘেরে আটকে রাখা।
আমার এক তরুণী আত্মীয়া ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। একদিন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাকে গান গাইতে অনুরোধ করলে সে বলল, সে আর রবীন্দ্র সংগীত গায় না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম সে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি মনে করে সে জন্য মুসলমান হয়ে তাঁর গান গাইবে না। সেই ষাটের দশকের পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক চেতনার ধারাবাহিকতা। আগে যে বলেছি, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে ¯্রষ্টার সম্পর্ক খুঁজে গেছেন চিরদিন, তার অর্থ হলো তিনি ধর্মীয় মোড়কে জীবন দর্শন করেন নি। বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে। দ্বিজাতি তত্ত্বের রাজনৈতিক ব্যর্থতা প্রমাণিত হয় পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে। সকল বাংলাদেশীদের–হয়তো খুব ক্ষুদ্র একটি ব্যতিক্রমী অংশ ছাড়া–সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরির আর্জি আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো সাধারণত ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে হাইওয়ে টু হেভেন বা সৃষ্টিকর্তার পথে যাবার জন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর সবলতা যেমন আছে, তেমনি তাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। কারণ যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দেখভাল করেন, তারা মনুষ্যসন্তানই এবং তাদের সীমাবদ্ধতা যখন ধর্মের সংজ্ঞার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়, তখন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তায় বিকৃতি ঢোকে। এ বিকৃতির একটি রাজনৈতিক সমীকরণ হলো যখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি বানাতে চেয়েছিলো, আর এর প্রলম্বিত সামাজিক ব্যবহার হচ্ছে যখন আমার আত্মীয়া রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি মনে করে তাঁর গান গাওয়া বন্ধ করল।
সাম্প্রদায়িক চিন্তার মূল দর্শন হলো অহংকার–আত্ম-অহংকার। তুলনা ছাড়া, যুক্তি ছাড়া নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা দেওয়া। আর সাম্প্রদায়িক চিন্তার সামাজিক দিক হলো মানুষকে তার জৈবিক গুণাবলী ব্যতিরেকে সংজ্ঞায়িত করা। ধর্ম-জাত-পাত-দেশ-সমাজ ব্যতিরেকে সব মানুষের ক্ষুধা, কাম, তৃপ্তি, শয়ন, বাৎসল্য, ঘৃণা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি আছে। জৈবিক গণতন্ত্র। কিন্তু সাম্প্রদায়িক চিন্তায় মানুষ তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিভাত হয় না, হয় কোন একটা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে উত্তর আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী সন্ত অগাস্টিন মৌলবাদী ব্যাখ্যা দিলেন যে কেবল খ্রিস্টান সন্তানেরাই ঈশ্বরের কৃপা লাভ করতে পারবে, কারণ অ-খ্রিস্টানরা মানুষ নয়। ইতালির অভিজাত বংশীয় খ্রিস্ট-ধর্ম চিন্তক জুলিয়ান ধমকে উঠলেন। বললেন, পাগলামী যুক্তি। পরম করুণাময় ইশ^র কি প্যাগান (অখ্রিস্ট্রিয় লোক) শিশু কষ্ট পেলে তাতে খুশি হবেন? বললেন, প্যাগান নারীর সতীত্ব যদি সতীত্ব না হয় তা হলে তাদের প্রসূত বাচ্চারাও প্রকৃত মানুষ নয়, তা হলে তাদের উৎপাদিত শস্য শস্য নয়।
উত্তরাধুনিক যুগে তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল উদ্বোধনের সময় বিশ^ব্যাপী মানবতার ঐক্য বাড়ার কথা থাকলেও, হয়েছে সাম্প্রদায়িক চিন্তার ব্যাপক বর্ধন। বড় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মাঝারি সাম্প্রদায়িকতা থেকে ছোট সাম্প্রদায়িকতা–সবগুলোই ব্যাপক বেড়ে গেছে। এ অস্থিরতাকে বর্জন করার উপায় নেই, কিন্তু প্রতিরোধ করার রাস্তা আছে এবং সে পথে আমাদের হাঁটতে হবে।
প্রচারযন্ত্রনির্ভর সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সংকট নেই। তাঁর জন্মদিন সহ অন্যান্য জাতীয় দিবসে রবীন্দ্রনাথকে আমরা তাঁর গান, কবিতা, গীতিনাট্য ও নাটক দিয়ে সামনে নিয়ে আসি। কিন্তু এর বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট শক্তিশালী। এটা বাজারে গেলে সাধারণভাবে লোকের কথাবার্তা থেকে জানা যায়। এটার কারণ হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে খোদ বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রবল কোন সচেতনতা নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন, পঁচিশে মার্চ কালরাত্রির দিন, কিংবা পনের আগস্টে অকাতরে বিয়ের তারিখ ফেলছে–এরকম দেখা আমার অনেক হয়েছে। আত্মবঞ্চনা প্রবল। বাংলায় শ্বাস নিচ্ছি, পরিপুষ্ট হচ্ছি, কিন্তু বাংলাকে মনে করছি অন্য ভাষার চেয়ে ইতর। সে রকম রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া চলে না প্রায়, কিন্তু তাঁকে মনের মাঝে স্থান দিচ্ছি না।
আবার শেক্সপিয়ারের কথায় আসি। শেক্সপিয়ারকে ইংরেজ এবং আমেরিকানরা যে ভাষায় পড়ছে, তাদের ধর্মও তারা সে ভাষায় পড়ছে। যখন তারা জেনেসিস পড়ছে, “মেইল অ্যান্ড ফিমেইল ক্রিয়েইটিড হি দেম”–হিব্রু এবং রোমান ভাষার ইংরেজি অনুবাদে সেটা তারা পড়ছে যে আদম এবং ইভের সৃষ্টি হলো। আবার শেক্সপিয়ার যখন মেজার ফর মেজার নাটকে ইসাবেলার মুখ দিয়ে অ্যাঞ্জেলোকে বলছেন, “আপনার কী হবে ভেবে দেখেছেন, যদি তিনি যিনি সবচেয়ে বড় বিচারক, তিনি আপনার বিচার করেন, আপনার মুখোশ কি ধরা পড়বে না?” খ্রিস্টান পাঠক মাত্রই বুঝতে পারে এটা হচ্ছে যিশু খ্রিষ্টের “সারমন অন দ্য মাউন্ট” (ম্যাথু ৭:১২) থেকে নেয়া, যেখানে তিনি বলেছেন, “জাজ নট দ্যাট ইয়ে বি নট জাজড”–এমনভাবে বিচার করো না, যে পাপে হয়তো তুমিও দন্ডিত হতে পারো।
মাতৃভাষার মধ্যে ধর্মের সর্বাঙ্গীন চর্চা কেন হবে না, বোঝা দুরূহ। খুব কম লোকই আমাদের ধর্মের ভাষাটা জানেন, ব্যুৎপত্তিতো দূরের কথা। কিন্তু দেশের আপামর জনগোষ্ঠী কোনদিন শত চেষ্টা করলেও–ধর্মের নামে হোক, চাকরির নামে হোক–অন্য একটা বিদেশী ভাষা রপ্ত করতে পারবে না। তাদেরকে ধর্মের কথা শোনাতে হবে মাতৃভাষায়–সব ধরনের আচার পালন সহ। এক লক্ষ লোক বা কয়েক লক্ষ লোক ধর্মের নামে বা কর্মের নামে বিদেশী ভাষা রপ্ত করবে, তার চেয়ে ধর্মের বাণী এবং কর্মের বাণী নিজের মাতৃভাষায় কয়েক কোটি লোক পালন করলে অনেক ভালো নয় কি?
বাংলাদেশে আমরা বেশ খানিকটা আত্মপ্রবঞ্চক সমাজ তৈরি করে যাচ্ছি, যেখানে জীবনবোধের সঙ্গে ধর্মীয় বোধের কোন সমান্তরাল লেনদেন হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, সেটা ওপরে ব্যাখ্যা করেছি। আরেকটু বলি, সাহিত্য সৃষ্টি হয় মূলত জীবন ও ধর্মীয় অঙ্গিকারের মধ্যে সেতু স্থাপনের জন্য। পৃথিবীর সব বড় সাহিত্যই সৃষ্টি হয়েছে মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস)এর সঙ্গে সমন্বয় একদিকে, অন্যদিকে বোঝাপড়ার সৃষ্টির জন্য–এবং সেটা হয়েছে যার যার মাতৃভাষায়।
কিন্তু আমাদের ভাষা বাংলা, আমাদের সাহিত্যও বাংলায়, কিন্তু আমরা ধর্মকে রেখেছি অন্য একটা ভাষায় পরিবেশিত করে। ফলে যুযুধান ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ফলে রবীন্দ্রনাথের মতো অমল জ্যোতিষ্ক আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আমার আত্মীয়ার মতোই পরিত্যাজ্য–কারণটা, অবোধ সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতাকে উপড়ে ফেলার কাজটা অনেক জটিল, কিন্তু সম্ভব।
ইংরেজি বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।