তুমি যে আমার

রুনু হক

স্যোসিওলজি এম.এ পাশ করার পর লিজা চাকরি পেয়ে গেলো একটা সরকারি অফিসে। যশোরের মতো ছোট্ট শহরে সে সময় খুব বেশি মেয়ে বিএ পাশ করে চাকরি করতো না। বেশির ভাগ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যেতো আইএ পড়তে পড়তেই। খুব বেশি হলে বিএ পাশের পরপরই। ছোট্ট মফস্বল শহরে এর চেয়ে বেশি বয়স পর্যন্ত মেয়ে ঘরে রাখতে যথেষ্ট ভয়ই পেতো মা-বাবারা। কিন্তু লিজা ছিল কঠোর মনোভাবাপন্ন শক্ত মনের এক মেয়ে। তার মা-বাবার ৭ কন্যা সন্তান থাকলেও কোন পুত্র সন্তান নেই। সুতরাং লিজা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল নিজের কাঁধে মা-বাবা ও ছোট দুটি বোনের দায়িত্ব তুলে নিবে। যা ভেবেছিলো লিজা তা বাস্তবে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। বড় চার বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। তার চেয়ে ছোট আরো দু’বোন- শেফালি আর বেলি। মা-বাবার বেশ বয়স হয়ে গেছে। তার ওপর বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সুতরাং সে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পেয়ে মহা খুশি। তবে দাপ্তরিক কাজে মাঝে মাঝেই তাকে যেতে হবে ট্যুরে। আশেপাশের আরো ছোট শহরকে সামাজিক উন্নত করার জন্য শিক্ষা দিতে যেতে হবে তাকে, বিশেষ করে অশিক্ষিত মেয়েদেরকে সুশিক্ষার মাঝে আধুনিকভাবে জীবনযাপনের পদ্ধতি শিক্ষা দিতে।
কুশিক্ষা আর কুসংস্কার মুক্ত জীবন। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জ্ঞান, এ সবই থাকতো তার কাজের অন্তর্ভুক্ত। খুবই নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অল্প দিনের মধ্যে সবার কাছে ভালো একজন করিৎকর্মা মহিলা কর্মচারি হিসেবে সে পরিচিতি অর্জন করল। অফিসের ছোট-বড় সবাই তাকে পছন্দ করতো মধুর ব্যবহারের জন্য। এদিকে বিয়ের বয়স যে পার হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।
মা বলতেন, হ্যাঁরে লিজা তোর চাকরিতো তিন বছর হয়ে গেলো। এখন বিয়ে-থা করে সংসারী হবি না? কৈ মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে লিজা বলতো, কি যে বলেন মা। আগে আমি ছোট বোন শেফালি-বেলি দু’জনের বিয়ে দেবো। তারপর নিজের কথা ভাববো।
মা বলতেন, শেফালি আর বেলির কথা তুইতো নিজের বিয়ের পরও ভাবতে পারবি। লিজার ভাত খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আঙুল চেটেপুটে খেতে খেতে বললো, মা আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না। বাবাতো আমায় নিয়ে ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন, আমি আপনাদের ছেলের আশা পূর্ণ করবো।
মা বলতেন, সেতো কথার কথা! আত্মীয়-স্বজনরাতো নানা কথা বলে। আমরা নাকি মেয়ের কামাই খাওয়ার জন্য তোকে বিয়ে দিচ্ছি না!
কাঁশার থাল ধুয়ে রাখতে রাখতে লিজা বলতো, মানুষের কথায় কান দেবেন না। চাকরিতে যোগ দেয়ার এক বছরের মধ্যেই সে নিজের টাকায় একটা গাড়ি কিনে শিখে নিলো ড্রাইভিং। তার ছোট্ট মরিসন নীল রঙের গাড়ি চালিয়ে সে যখন অফিসে যেতো, সবাই চেয়ে চেয়ে দেখতো তাকে। তার স্মার্টনেস, তার সাহস শহরের সবার আলোচনার বস্তু হয়ে উঠলো। ছোট্ট শহর, সবাই চেনে সবাইকে। বিশেষ করে লিজা সবার আলোচনার বিষয় হয়ে গেলো। অনেকে বলতোÑ এতো বেশি স্মার্ট মেয়ে! এ কি ঘর সংসার করতে পারবে নাকি! ওরতো একরকম উড়নচন্ডী স্বভাব!
লিজা দেখতে খুব বেশি আকর্ষণীয় না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় একটা আকর্ষণ ছিলো। সবসময় যা অবহেলাও করা যেতো না। অনেকে অনেক কাজে তার সাহায্যও চাইতো। ঠিক সে সময় শহওে সহকারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিলেন অবিবাহিত সিএসপি অফিসার সিদ্দিক। অল্প দিনের মধ্যে জনাব সিদ্দিক নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কর্মযজ্ঞ দিয়ে সকলের পরিচিতি অর্জন করলেন। চাকরির পাশাপাশি আবার কাব্যচর্চাও করতেন তিনি। শহর থেকে প্রকাশিত নতুন সপ্তাহিকীতে কবিতাও লিখতেন তিনি। একটা মিটিংয়ে তার সঙ্গে লিজার পরিচয় হয়ে গেলো!
সিদ্দিক মিটিং শেষে লিজার কাছে এসে বললো, কেমন আছেন?

  • ভালো। আপনি?
  • ভালো আছি। আমার বাসায় আমি একটি পার্টির আয়োজন করেছি। আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাতে চাচ্ছি। এলে খুশি হবো।
  • কবে? কখন?
  • পরশু সন্ধ্যায়।
    লিজা আগেই শুনেছিলো সিদ্দিক সাহেব নাকি বিয়ের জন্যে পছন্দসই পাত্রীর খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে তার নাকি পছন্দ খুব সুন্দরী মেয়ে! লিজা মনে মনে ভাবলো, সে নিজে বলতে গেলে শহরে প্রথম সরকারি কর্মচারি। খুব সুন্দরী তাকে বলা যাবে না। কিন্তু তাকে নিশ্চয়ই একজন সম্মানিত মহিলা অফিসার হিসেবেই নিমন্ত্রণ করেছেন ভদ্রলোক।
    সন্ধ্যাবেলা সন্ধ্যাসাজে সেদিন লিজাকে খুবই আকর্ষণীয় লাগছিলো। গাঢ় সবুজের বড় বড় ফুলের ছাপ দেয়া জর্জেটের সাদা শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ আর হাল্কা মুক্তার গহনায় ববকাট চুলে তাকে অনেক সুন্দরীর মাঝেও চোখে পড়ছিলো। অনেকের অনেক সুন্দরী স্ত্রী তার দিকে ঈর্ষান্বিত চোখে চেয়ে দেখছিলো। অনেকে পোলাও-কোর্মা খেতে খেতে প্রশ্ন করলো, আপনি এখনও বিয়ে করেননি কেন মিস্্ লিজা?
    সরাসরি এমন আক্রমণে একটু অপ্রস্তুত হলেও লিজা নিজেকে মুহূর্তে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো, এখনও সময় হয়নি তাই! বলে সে হাসলো। একজন মুখরা মহিলা বলে বসলো, আমিতো আপনার চেয়ে ছোট। আমার দু’টো বাচ্চা। আর আপনার সময় হয়নি বিয়ের, বলেন কি!
    লিজা একটু হেসে মিষ্টির টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। আর তাড়াতাড়ি সে পার্টি থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। রাতে শুয়ে চোখে ঘুম এলো না। সব বিবাহিতদের মাঝে সেই ছিলো একমাত্র অবিবাহিতা। তাকে নিয়ে মহিলাদের গুঞ্জন ও বক্রদৃষ্টি এবং কথার ফুলঝুড়ি তার রাতের ঘুম কেড়ে নিলো। তার চিন্তা, আগে শেফালির বিয়ে দেবে। শেফালির বিএ পরীক্ষা শেষ। শেফালি যথেষ্ট সুন্দরী। একজন কলেজের প্রফেসারের সঙ্গে তার বিয়ে প্রায় ঠিক। শেফালির বিয়ে না দিয়ে কিছুতেই সে বিয়ে করবে না! বেলি বেশ ছোট, সবে আইএ পড়ছে। বাবার বেশ বয়স হয়েছে। ডায়াবেটিস আর ব্লাড প্রেসারের রোগী। মাকে বাতের ব্যথায় ধরেছে। সে যা প্রতিজ্ঞা করেছে মনে মনে, তা পূর্ণ না করে স্বার্থপরের মতো নিজের জীবন গোছাতে পারবে না। মায়ের বিয়ের সোনার সাত ভরি হার ভেঙে শেফালির জন্য গহনা তৈরি করা হয়েছে। আর লিজার জমানো টাকা দিয়ে বিয়ের খাওয়ার আয়োজন করা হলো। বিয়ের হয়ে গেল শেফালির।
    কিছুটা নিশ্চিন্ত লিজা। একদিন অফিসে বসে নিজের মনে কাজ করছিলো লিজা। পিয়ন এসে জানালো সিদ্দিক সাহেব তার সঙ্গে দেখা করতে চান।
    লিজা বললো, আসতে বলো।
  • সালামালাইকুম।
    হাসিমুখে লিজা বললো, ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসুন। হঠাৎ এ সময় আমার অফিসে!
  • এদিক দিয়ে একটা কাজে যাচ্ছিলাম। জিপ থামিয়ে ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। সেদিন পার্টি থেকে আপনি খুব তাড়াতাড়ি চলে এলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। কেউ আপনাকে অসম্মান করে কথা বলেনিতো।
  • না না, ওসব কিছু না! এছাড়া আমি মানুষের কোন বাঁকা কথা গ্রাহ্য করি না। চা খাবেন?
  • আচ্ছা দিন।
    দু’কাপ চা আনতে বলে লিজা পিয়নকে ডেকে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সিদ্দিক বলল Ñ আপনাকে একটা কথা বলি, মনে কিছু করবেন না।
  • না না, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন!
  • আজ সন্ধ্যায় আপনি কি ফ্রি?
  • কেনো, বলুনতো!
    Ñ আমার সন্ধ্যায় তেমন কোন কাজ নেই। চলুন না সুচিত্রা-উত্তমের হারানো সুর সিনেমাটা দু’জনে দেখতে যাই।
    কোন রকমে চা গলাধরকরণ করে লিজা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললোÑ এটা একটা ছোট্ট মফস্বল শহর। কতো যে আজগুবি গল্প রটনা হয়ে যাবে, আপনার সে খেয়াল আছে!
  • আমি পরোয়া করি না!
  • আপনি পুরুষ মানুষ। আপনার কি আসে যায়। আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য কতো কঠিন হবে। সেটাও আমাকে চিন্তা করতে হবে। এছাড়া আমি শুনেছি, আপনি খুব সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করেন, আমি কিন্তু খুব সুন্দরীদের দলে পড়ি না!
    সিদ্দিক বলে, আপনার ধারণা ভুল। সবসময় শারীরিক সৌন্দর্য যে মানুষের মনে শিকড় গাড়ে, তা নয়। কারো মাঝে এমন কিছু থাকে, যা বাইরের সৌন্দর্যের চেয়ে ভেতরের সৌন্দর্য্যক প্রকাশ করে, আকর্ষণ করে মানুষের মনকে!
    লিজা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখে। একটু চিন্তা করে, ভদ্রলোককে কি উত্তর দেবে!
    সিদ্দিক বলে, আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। শহরের মানুষের দুর্নামের বোঝা আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে না।
  • ঠিক আছে। আমি বাসায় গিয়ে আমার মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করে আপনাকে জানাবো। আমাকে একটু সময় দিন।
  • তাহলে আজকে সিনেমায় যাওয়া হচ্ছে না!
  • না।
  • আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, আপনি একজন স্বাধীন, নিজের মনোবল নিয়ে সরকারি চাকরিরত স্মার্ট মহিলা হয়েও সমাজের ভয়ে ভীত!
    লাজুক হেসে লিজা বলে, আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের এটাই ভীতি। সমাজকেতো এড়িয়েও চলতে পারি না আমরা, বিশেষ করে মেয়েরা!
  • ঠিক আছে। আপনার কথাই চলবে। দু’দিন পর আমি আসবো।
    বাসায় এসে মা-বাবা দু’জনকে বলতে তারা বলে বসলেন, এসব কি, সিনেমা দেখতে যাওয়া। যদি তোমাকে তার পছন্দ হয়, বিয়ের প্রস্তাব দিলেইতো হয়। বলে দিও, না আমরা কেউ রাজি নই, তার এ প্রস্তাবে।
    এরপরতো আর কথা চলে না। আর সিদ্দিকের সঙ্গে লিজার সিনেমা দেখতে যাওয়া হয় না। তবে সে নিজের ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে হারানো সুর সিনেমা দেখে এসেছে দু’বার। নতুন সিনেমা এলে লিজার দেখা চাই।
    তার ক’দিন পর আবার অন্য একটা শহরে যেতে হয় ট্যুরে লিজাকে। যশোর থেকে রাজশাহী। নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসের কামরায় উঠে বসে লিজা। এক স্টেশন পরে ট্রেন থামে। সেখান থেকে এক ভদ্রলোক ওঠে ট্রেনের একই কামরায়। বেশ স্মার্ট, লম্বা-পাতলা। চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। লিজা এবার নিজেই মুগ্ধ চোখে তাকায় ভদ্রলোকের দিকে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। ট্রেনের কামরায় কেবলমাত্র তারা দু’জন। একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ। দু’জনেই দেখে কখন যেনো তারা কথায় কথায় দু’জনের মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছে! ভদ্রলোক সদ্য লন্ডন থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। কৃষিবিদ, বড় চাকরি, এটোমিক এনার্জির ডিরেক্টর।
    লিজার খুব ভালো লেগে যায় ভদ্রলোককে। আর আনিসুল ইসলামেরও লিজাকে খুব ভালো লেগে যায়। ট্রেনের কামরায় এদের আলাপ এতো দূর গড়িয়ে যায় যে, দু’জনের কারোই খেয়াল থাকে না তারা সদ্যপরিচিত দু’টি নর-নারী! দু’জনের দু’জনকে বহু আপন, বহু পরিচিত নিকট একজন মনে হয়!
    নর্থ ক্যারোলিনা।