তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাতছানি

সাব্বির খান

কয়েক দিন আগে দরজা খুলে ঘরে পা রাখতেই দেখলাম ফ্লোরে বেশ কিছু চিঠি ছাড়াও একটি বুকলেট পড়ে আছে। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো চিঠিগুলো হাতে তুলে নিতেই বুকলেটের কাভারে সুইডিশ ভাষায় লেখা শব্দগুলোর ওপর চোখ আটকে গেল। শব্দগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করলে হয়, ‘Swedish Citizens are required to take precautionary measures in time of war or crisis! অর্থাৎ ‘যুদ্ধ অথবা সংকটকালে সুইডিশ নাগরিকদের প্রস্তুতিমূলক করণীয়’ ইউরোপে এসেছি সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে। ‘সামাজিক-ইউরোপকে’ দেখেছি একটু একটু করে বদলে যেতে। বিশ্বায়নের ধারাবাহিকতায় ইউরোপের মানুষগুলো বদলেছে খুব ধীরে, অগোচরে ও অসংশয়ে অনেক বদল আর পরিবর্তনের মধ্যেও এ ধরনের যুদ্ধবিষয়ক কোনো বই, দেয়াললিখন, বুকলেট বা পোস্টার কখনো চোখে পড়েনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে বিগত এক যুগ ধরে উগ্র ডানপন্থীদের বাধাহীন লং মার্চে কম্পমান হতে দেখছি ইউরোপের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম খুব সাম্প্রতিক সময়ে কী যে হলো, বাতাসে কান পাতলেই যেন শোনা যায়, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ কথাটি চাপা শব্দ দুটি অগোচরে ঘুরছে ইউরোপের কান থেকে কানে, নিঃশব্দে সুইডেন তথা ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখনো যারা বেঁচে আছেন, সংখ্যায় তারা খুবই কম। সুইডেনের নতুন প্রজন্ম যুদ্ধ বলতে মূলত তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের দেখে কিছুটা বুঝে থাকে। আর বাকিটুকু জেনে নেয় পশ্চিমা শাসনাধীন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
সুইডেনের সরকার কর্তৃক এ ধরনের সতর্কতামূলক জরুরি বুকলেট (‘জনগণের প্রতি ব্যক্তিগত চিঠি’ বলাই শ্রেয় হবে) ৫০ লাখ পরিবারের কাছে পাঠানোর ঘটনাটি নিঃসন্দেহে কোনো নৈমিত্তিক ঘটনা যে নয়, তা সুইডেনের ২০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। ২০১৪ সালে ‘২০০ বছর যুদ্ধহীন-শান্তির সুইডেন’ হিসেবে বছরটি পালন করেছিল। সুইডেন সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা গত ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহে জড়ায়নি। নিকট-অতীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সুইডেন ছিল নিরপেক্ষ একটি দেশ। ১৯০১ সাল থেকে আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশে দেওয়া হচ্ছে নোবেল শান্তি পুরস্কার। আধুনিক বিশ্বেও সুইডেন একটি নিরপেক্ষ, শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত। সুইডেন এমন একটি দেশ, যে দেশে কোনো পেশাদার সেনাবাহিনী নেই, যদিও ১৮ থেকে ২৮ বছরের নাগরিকদের সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণ থেকে সুইডেনকে বাঁচাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দাবি তুলেছিল সুইডেনকে ন্যাটো জোটভুক্ত করার জন্য। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের নারাজির কারণে সে ইচ্ছা বেশি দূর এগোয়নি। তার পরও সুইডেন সরকার কেন যুদ্ধ বা দুর্যোগকালীন সতর্কতার জন্য পরামর্শমূলক একটি বুকলেট বা হ্যান্ডবুক সুইডিশ নাগরিকদের কাছে পাঠাল, তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে বৈকি অন্তরালে ইউরোপে কী হচ্ছে আসলে
গত ২ মে থেকে ১৪ মে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ এস্তোনিয়া ও লাতভিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো (NATO) সামরিক মহড়া করেছিল। ১৯৯১ সালের পরে ন্যাটো কর্তৃক এটাই ছিল সবচেয়ে বড় মহড়া। ১৬টি দেশের প্রায় তিন হাজার সেনা সদস্য এই মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এ ছাড়া জুন মাসেই লাতভিয়ার ভূমিতে অনুষ্ঠিত হবে আরো একটি সামরিক মহড়া। এ বছর জুন মাসে বাল্টিক দেশগুলো যৌথভাবে আয়োজন করছে ‘বেলটোপস’
(BALTOPS) এবং ‘সাবের স্ট্রাইক-২০১৮’ (২০১৮) নামে আরো একটি বৃহৎ সামরিক মহড়া। ইউরোপের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে ঘাঁটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে কমপক্ষে চার হাজার সদস্যের একটি চৌকস ব্রিগেড, ৯০টি আব্রামস ট্যাংক, ব্র্যাডলি যুদ্ধযান, ১৮টি বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র Paladin howitzers ছাড়াও প্রচুর সামরিক যান। এ বছর গ্রীষ্মে পোল্যান্ড আয়োজন করছে ন্যাটোর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া, যার কোড নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যানাকোন্ডা-২০১৮’। শীতল যুদ্ধোত্তর এই প্রথমবারের মতো সামরিক জোট ন্যাটো আয়োজন করছে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সামরিক মহড়া। এই মহড়ায় অংশ নেবে এক লাখের বেশি সেনা, পাঁচ হাজার বিভিন্ন ধরনের সামরিক যান, ১৫০টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এবং ৪৫টি যুদ্ধ জাহাজ। এ ছাড়া ২০১৮ সাল শেষ হওয়ার আগেই এ ধরনের আরো ৮০টি মহড়া অনুষ্ঠিত হবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
পশ্চিমা শক্তিগুলোর যুদ্ধ মহড়ার অংশ হিসেবে যে এসব হচ্ছে, তা রাশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়। বিশেষ করে একেবারে রাশিয়ার বর্ডারে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে প্রস্তুতিমূলক মহড়াগুলো যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক, তা বোধ করি যেকোনো সামরিক বোদ্ধাই একমত হবেন। রাশিয়ার সীমান্তে অনুষ্ঠিত মহড়াগুলোর কৌশল ও তীব্রতা যে একটা সমূহ যুদ্ধে জড়াতে মস্কোকে বাধ্য করার নামান্তর, তা পশ্চিমা সমরবিদরা স্বীকারও করছেন রাশিয়ার বর্ডারঘেঁষা পূর্ব ইউক্রেনের ডোনবাসের পরিস্থিতি যখন দিন দিন উত্তপ্ত হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘জেভ্যালন-অ্যান্টিট্যাংক সিস্টেম’ ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর কাছে সরবরাহ করে উত্তেজনায় আরো বেশি ঘৃত ঢালছে গত ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, “সিরিয়ায় অবস্থানরত ইউএস সেনাবাহিনীর অভিযান চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং ইউএস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স এবং তাদের ‘রহস্যময়’ স্থানীয় পার্টনারদের কথা উল্লেখ ছাড়াও তুরস্ক, ইসরাইল, জর্দান, ইরাক ও লেবাননের নামও উল্লেখ করা হয়।” এ দিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পারমাণবিক বোমা নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির সঙ্গে প্রতারণার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের অভিযোগকে সমর্থন জানান। ট্রাম্পের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই ইসরাইলের পার্লামেন্ট প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে যেকোনো সময়, যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং আক্রমণ করার একক ক্ষমতা দেয়। এর পরই ট্রাম্প ঘোষণা দেন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক বোমা নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে সরে আসার। ফলে দেশ দুটির পরস্পরের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পথে আর কোনো বাধা রইল না। সমরবিদ্যার তত্ত্বানুযায়ী বর্ণিত প্রতিটি পদক্ষেপই যে সুচিন্তিত ‘যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক’, তা যেকোনো সমরবিদই স্বীকার করবেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে ইউরোপের অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও দিচ্ছেন প্রায় একই ধারার সিদ্ধান্ত। অনেকে বিশ্বাস করেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেন ‘ঘরের ঠিক কোনায়’ অবস্থান করছে। পৃথিবী নামের গ্রহটিতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষটি বেধে যেতে পারে যেকোনো সময়। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, ইউরোপিয়ানরা ভবিষ্যেক দেখে অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বিশ্বব্যাপী সমূহ সংঘর্ষের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ খুব সহজেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারলেও ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের নাগরিকরা এ ব্যাপারে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবের যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪ শতাংশ মানুষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বিশ্বাস করলেও ১৫ শতাংশ বিশ্বাস করে বিশ্বশান্তির সম্ভাবনাকে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ের নাগরিকরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে বলে বিশ্বাস করে না ডেনমার্কের নাগরিকদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে বিশ্বাস করলেও ৪৫ শতাংশ বিশ্বাস করে না। তবে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের নাগরিকরাই বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে জঙ্গিধারার আক্রমণকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। অনেক ইউরোপিয়ান তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকেও বুঝে থাকে।
সুইডেন সরকারের আদেশে ‘সিভিল প্রটেকশন এন্ড ইমার্জেন্সি এজেন্সি’ নামের একটি সরকারি সংস্থাকে ‘যুদ্ধ অথবা সংকটকালীন সময়ে সুইডিশ নাগরিকদের প্রস্তুতিমূলক করণীয়’ শিরোনামের বুকলেটটি সুইডেনের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বুকলেটের সূচিতে রয়েছে মোট তিনটি প্রধান অধ্যায় ‘সংকটকালীন প্রস্তুতি’, ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী’ এবং ‘আগাম সতর্কতা’। ‘সংকটকালীন প্রস্তুতি’ অধ্যায়ে রয়েছে চারটি বিভাগজরুরি প্রস্তুতি, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, সন্ত্রাসী হামলা ও বাসস্থানে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পরামর্শ। ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী’ অধ্যায়ে রয়েছে তিনটি বিভাগসুইডেনের সার্বিক প্রতিরক্ষা, সুইডেন আক্রান্ত হলে করণীয় ও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। ‘আগাম সতর্কতা’ অধ্যায়ে রয়েছে তিনটি বিভাগ জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, জরুরি অবস্থায় অ্যালার্ম এবং আশ্রয়কেন্দ্র বা বাংকার। উল্লিখিত তিন অধ্যায়ের নিচে যে আলাদা বিভাগগুলো রয়েছে, সেখানে বিস্তারিত বর্ণনা, আদেশ ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে। বুকলেটটি যে একটি সমূহ যুদ্ধের পরামর্শমূলক ‘হ্যান্ডবুক’, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে, যার ভয়াবহতা থেকে ১৭ কোটি মানুষ কোনোভাবেই পরিত্রাণ পাবে না। সন্তর্পণে যেভাবে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের জনগণকে রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেখানে বাংলাদেশকে নির্বিকার দেখলে ভয়ের মাত্রাটা বহুগুণে বেড়ে যায় বৈকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কারোরই কাম্য নয় তবু সম্ভাব্য যুদ্ধটি যদি জগদ্দল পাথরের মতো চেপেই বসে, তাহলে সে ভার লাঘবের কিছুটা দায় সরকারের ওপর অবশ্যই বর্তায়। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের পদাঙ্ক অণুসরণের কোনো বিকল্প নেই

লেখক : সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক ও বিশ্লেষক