থামছে না আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাত, রক্তাক্ত সবুজ পাহাড়

চট্টগ্রাম : আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও ভূমির কর্তৃত্ব নিজেদের দখলে রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক ঘটছে হত্যাকা-। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া এবং জড়িতরা ধরা না পড়ায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না এ সব হত্যাকা-। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে টার্গেট করে হত্যা করছে। ফলে পার্বত্য এলাকায় সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর ভোরে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার রামসুপারি পাড়া এলাকায় দুইজনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেনÑ আকর্ষণ চাকমা (৪২) ও সুমন্ত চাকমা (৩৫)। এ ঘটনার পর নানিয়ারচর উপজেলায় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে। স্থানীয়রা জানান, ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ ও জেএসএস সংস্কার গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে ওই দুই ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হন। নিহতরা রামসুপারি পাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপের চাঁদা আদায়ের কালেক্টর ছিলেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সংঘটনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এখানে সাধারন বাঙালি ও পাহাড়িরা শান্তিতে বসবাস করছে এবং তারা শান্তি চায়। হত্যাসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধী যেই হোক কোন ছাড় দেয়া হবে না। সাধারন বাঙালি ও পাহাড়িরা যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে জন্য পুলিশ কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে মাঠ দখলে নিতেই আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। গত দুই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে খুন হয়েছেন প্রায় ১০০০ জন। সম্প্রতি এ খুনোখুনি আরও বেড়েছে। আইনশৃখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলে মূল সংগঠন হলো জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এই সমিতির সঙ্গে ১৯৯৬ সালে সরকারের শান্তি চুক্তি হয়। এ সমিতির কর্তৃত্ব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। চাঁদাবাজির ভাগাভাগি আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয় জেএসএস। জেএসএস (সন্তু লারমা গ্রুপ) ও জেএসএস (সংস্কার পন্থী)। একই কারণে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এটা ভেঙে ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক (সংস্কার) । বর্তমানে জেএসএস (সন্তু লারমা) রাঙামাটি জেলার একাংশে নীরব চাঁদাবাজি করে আসছে। অপর দিকে মূলত পার্বত্য অঞ্চলে জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক (সংস্কার) এই তিনটি গ্রুপের মধ্যে চলছে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টার্গেট কিলিং।
সূত্র জানায়, এই চারটি গ্রুপের নেতৃত্বের কোনো আদর্শ নেই। কেউ কাউকে বেশিদিন নেতা মেনে নিতে পারে না। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বই সংঘাতের অন্যতম কারন। তিন পার্বত্য জেলায় কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি, যানবাহন, ঠিকাদারি সব সেক্টর থেকেই আঞ্চলিক দলগুলো নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। তাদের এ চাঁদাবাজি পার্বত্য এলাকায় এখন ওপেন সিক্রেট।
জানা যায়, ইউপিডিএফ’ই (প্রসীত গ্রুপ) বছরে চাঁদা আদায় করে ৫০-৬০ কোটি টাকা। তাদের প্রতিপক্ষ দলগুলোরও চাঁদাবাজি খাতে আয় হয় এর কমবেশী। এলাকার নিয়ন্ত্রণ যার যত বেশি, ওই সংগঠনের চাঁদা আদায়ের পরিমানও তত বেশি। বিপুল অংকের চাঁদার টাকার নেশায় দলগুলো এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিতে লিপ্ত থাকে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশের পর থেকেই পাহাড়ে নাটকীয়ভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। ইউপিডিএফ থেকে ২০১৩ সালে বহিষ্কৃত তপন জ্যোতি চাকমার (বর্মা) নেতৃত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গড়ে ওঠে। তপন জ্যোতি চাকমা ইউপিডিএফের সাবেক সামরিক কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইউপিডিএফ সামরিক কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য এলাকায় বিশেষত নানিয়াচরসহ রাঙামাটি এবং খাগড়াচড়িতে ব্যাপক আধিপত্য গড়ে তুলেছিল। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার দীর্ঘদিন পর তিনি ২০১৭ সালে নিজেই ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন।
অতীতের চেয়ে আঞ্চলিক সংগঠনের দীর্ঘদিনের চলামান সংঘাত ২০১৫ সালের দিকে অনেকটা কমে আসছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ মাসের মাথায় গত ৪ মে দলীয় প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ (বর্মা) ছয়জনকে হত্যা করা হয়। দলের প্রধানের এই অপ্রত্যাশিক মৃত্যুতে বেকাদায় পড়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। গত ২৬ জুলাই রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের দাঙ্গাছড়া, রাইন্নাছড়া ও বেতাগী ছড়ায় সশস্ত্র তিন গ্রুপ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এ যুদ্ধে বন কুসুম চাকমা নামে জেএসএস (এম এন লারমা)-এর এক কর্মী নিহত হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের প্রধান প্রসীত বিকাশ চাকমাসহ ৪৪ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।