দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আতঙ্ক: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দামামা


ঠিকানা রিপোর্ট : বেশ কয়েক দিন আগ থেকেই পাকিস্তান-ভারতের উচ্চপর্যায়ে চলছিল উচ্চবাক্য বিনিময়। অনেকেই ভেবেছিলেন, এই বুঝি যুদ্ধ শুরু হয়। অবশেষে সেই যুদ্ধাবস্থার দিকেই ধাবিত হলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার জবাবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায় অন্তত ৩০০ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া ট্যুডে। দেশটির বিমানবাহিনীর একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ইন্ডিয়া ট্যুডে বলছে, সীমান্তরেখার কাছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ও লঞ্চ প্যাডে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। ভারতীয় বিমানসেনা দাবি করেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে তারা জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশ-ভারত-পাকিস্তান যদি সত্যিই যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পরমাণু বোমা ব্যবহার করে, তাহলে বিনা দোষে এসব দেশকেও কঠিন দায় মেটাতে হবে। ইতিমধ্যে দুই দেশ যেন সত্যি সত্যিই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জোট।
সংবাদ সংস্থার সূত্রে খবর, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৩টা নাগাদ ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান পাকিস্তান জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে লেজার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার সাহায্যে প্রায় এক হাজার কেজি বোমাবর্ষণ করেছে। তবে এ হামলায় হতাহতের কথা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। এ ব্যাপারে তারা কিছু ছবিও প্রকাশ করেছে। দেশটির দাবি, ভারত আক্রমণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রতিহত করেছে। ভারতের দাবি, ২১ মিনিটের পূর্বকল্পিত এ অপারেশনে বালাকোট সেক্টর থেকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে ভারতীয় বিমানসেনার যুদ্ধবিমান। এরপর বালাকোট, চাকোটি ও মুজাফফরাবাদে জয়েশ-ই-মোহম্মদের তিনটি লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করেছে ভারত।
বিমানসেনার দাবি, তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে জয়েশের কন্ট্রোল রুম আলফা-৩। দাবি করা হয়েছে, প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জঙ্গিকে খতম করা সম্ভব হয়েছে। তবে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এ হামলার জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে পাল্টা বিমান হামলা চালানোর চেষ্টা চালিয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতিরোধে তারা ফিরে গেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে পাকিস্তান সেনারা হামলার কথা স্বীকার করলেও হতাহতের কথা অস্বীকার করেছে। পাকিস্তান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বলেছে, সীমান্তরেখা লঙ্ঘন করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমান। তবে তাৎক্ষণিকভাবে জোরালো জবাব দেওয়ায় পালিয়ে গেছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর। এক টুইট বার্তায় গফুর বলেছেন, মুজাফফরাবাদ সেক্টর থেকে পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান। বালাকোট সেক্টরে বোমা ফেলেছে। তবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের এই হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন তিনি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াই করেছি। আমরা শান্তিকামী জাতি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সচেতন রয়েছি।
অন্যদিকে পাকিস্তানে ভারতের বিমান হানা সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, প্রায় ২১ মিনিট ধরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের আকাশে ছিল ভারতীয় বিমানসেনার যুদ্ধবিমানগুলো।
ভারতীয় সেনা সূত্রের খবর, চকোটিতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে রাত ৩টা ৫৮ মিনিট থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত। মুজাফফারাবাদে বোমাবর্ষণ চলে রাত ৩টা ৪৮ মিনিট থেকে ৩টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এ সেনা অভিযান নিয়ে সবিস্তার রিপোর্ট দিয়েছেন। তারা গোটা পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বিমানসেনার তরফে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে এই অভিযানের পর আন্তর্জাতিক সীমান্তে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এই অভিযানের পর ভারতীয় বিমানসেনাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ভারতীয় বিমানসেনার পাইলটদের সালাম জানাই। ভারতীয় বিমানসেনার অভিযানকে কুর্নিশ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লি­র মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রমুখ।
অপরদিকে কাশ্মীরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার পর ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের নওশেরা ও আখনুর সেক্টরে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করে গোলাবর্ষণ করেছে পাকিস্তান রেঞ্জার্স। এছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালের দিকে রাজৌরি ও পুঞ্চ সীমান্তেও ব্যাপক গোলাবর্ষণ করেছে পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী এই বাহিনী।
ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জম্মু-কাশ্মীরে অন্তত চারবার অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করে ভারী গোলাবর্ষণ করেছে পাকিস্তান রেঞ্জার্স। স্থানীয় সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নওশেরা ও আখনুর সীমান্তে গোলা বর্ষণ করেছে। এছাড়া কানাচক ও শাম্বা সীমান্তেও গুলি ছুড়েছে পাকিস্তান সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
উল্লে­খ্য, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামাতে আধা সেনা সিআরপিএফের একটি কনভয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা হয়। ওই হামলায় ৪৯ জন আধা সেনা জওয়ান নিহত হন। এর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, প্রত্যাঘাতের সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। তার পরই পুলওয়ামার ঘটনার ১২ দিনের মাথায় এ বিমান অভিযান।
ভারতের সব বিমানবন্দরে উচ্চ সতর্কতা : পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার জবাবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আকস্মিক হামলার পর যথাযথ জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসলামাবাদ। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ও লঞ্চ প্যাডে হামলার পর দেশের সব বিমানবন্দরে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে ভারত। আকস্মিক ওই হামলার পর ভারতের সব বিমানবন্দরে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে লুতিয়েন্স এলাকায় প্রতিরক্ষা স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে সীমান্তের কাছাকাছি পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকায় উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে সংশ্লি­ষ্ট প্রশাসন এবং পুলিশ।
যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকুন : সেনাবাহিনীকে ইমরানের নির্দেশ
সম্ভাব্য সব ধরনের পরিণতির জন্য তৈরি থাকতে দেশের মানুষ ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৩টার দিকে সীমান্তরেখার পাশে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযানের পর দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ভারতের ওই হামলার পর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্যদের নিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে জরুরি বৈঠকে বসেন ইমরান খান। বৈঠকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় হামলাকে চূড়ান্ত আগ্রাসন বলে মন্তব্য করা হয়। পরে ইমরান খান বলেন, ‘পছন্দনীয় সময়ে এবং সঠিক জায়গায় উপযুক্ত জবাব দেবে পাকিস্তান।’ বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে ইমরান খান সশস্ত্র বাহিনী ও দেশের সাধারণ মানুষকে সমস্ত পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই অঞ্চলে ‘ভারতের দায়িত্বহীন নীতি’কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
হামলা নিয়ে বাংলাদেশকে যা বলল ভারত : ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া এলাকায় বালাকোটের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিমান থেকে বোমা হামলা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশকে বক্তব্য দিয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সিঙ্গাপুর ও আফগানিস্তান।
এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পাকিস্তানে সন্ত্রাসী জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিফোনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে এ হামলার বিষয়টি জানানো হয়। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরাজ হামলার বিষয়টি পরিষ্কার করেন। এতে তিনি বলেন, শুধু পাকিস্তানে জইশ-ই-মোহাম্মদের ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। এছাড়া তিনি পাকিস্তানে হামলার বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ করেন।
পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা : ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর দেশ হওয়ায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কাশ্মীরকে ঘিরে উদ্ভূত এই পরিস্থিতি হুমকিস্বরূপ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা। এরই মধ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্ত অতিক্রম করে কাশ্মীরের পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশে বোমা হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
তবে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটি অতিদ্রুত চলমান এই উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা নেবে। দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যার সমাধানে নয়াদিল্লি­ এবং ইসলামাবাদের অতিদ্রুত আলোচনার টেবিলে বসা উচিত। কাশ্মীরে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেইন বলেন, এই অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে বিষয়টি আমাদের জন্যও যথেষ্ট চিন্তার। দুটি দেশই পরমাণু শক্তিসম্পন্ন হওয়ায় বিষয়টি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আরও দুশ্চিন্তার।