দালাল ধরে আমেরিকায়

জাকিয়া ফাহিম :

আমরা তিন বন্ধু-জাফর, রশিদ আর আমি মতিন।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে ঠিক করলাম দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। যেই কথা, সেই কাজ। চটজলদি তৈরি হয়ে বন্ধুদের নিয়ে রওনা দিলাম। ট্রেনে করে ঝিকঝিক শব্দে আর ঝাকুনিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি, তাদেরও আমার মতো একই অবস্থা। অতএব, কালবিলম্ব না করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

এদিকে ট্রেন ছুটে চলেছে তার হুইসেল বাজিয়ে। যখন ঘুম ভেঙে উঠলাম, তখন আড়মোড়া দিয়ে রশিদকে ডাকতেই মনে পড়ল, এখন কোন স্টেশনে আমরা আছি?

বাইরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম, আমাদের স্টেশন পার হয়ে এসেছি অনেক আগেই! তাই আমরা এখন কী করব ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম। আমাদের মধ্যে বুদ্ধিমান হলো রশিদ। তাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষে সে আমাদের বলল, সবার মালপত্র নিয়ে এখানেই নেমে পড়তে হবে। আর দেরি না করে আমরা সবাই নেমে পড়লাম।

নেমে তো পড়লাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাব কী করে? পরের ট্রেন আসবে আরও চার ঘণ্টা পরে। এতক্ষণ কোথায় কী করব? স্টেশনের পাশেই টিন ও বেড়ার একটি ঘর লক্ষ করলাম, সেখানে বেঞ্চিতে বসা কয়েকজন গালগল্প করছে আর চা পান করছে। সময় কাটাতে আমরাও সেই দোকানে গিয়ে তিন কাপ চা অর্ডার দিলাম আর কাচের কৌটা থেকে টোস্ট বিস্কুট নিয়ে খেতে শুরু করলাম।
এতক্ষণে খেয়াল করলাম, যারা চা পান করছিল, তারা খুব গম্ভীরভাবে আস্তে আস্তে কথা বলছিল। কান খাড়া করতেই বুঝলাম, এরা দালাল। টাকা নিয়ে বিদেশে লোক পাঠায়। আমরা চা পান করে আবার স্টেশনে ফিরে এলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমাদের কাক্সিক্ষত ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্মে এল, আমরাও তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠে বসলাম।

দেশের বাড়িতে খুব মজা করে আম-জাম-নারকেল আর খেজুরের রস খেয়ে আনন্দে বেড়ালাম। শেষে শহরে যখন ফিরে এলাম, তখন আমাদেরও বিদেশে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এল। রশিদ এক দালালের খোঁজ নিয়ে তাকে জানাল, আমাদের ইচ্ছা আমেরিকা যাব। দালালের সঙ্গে কথা বলে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। একদিন সত্যি সত্যিই আমরা কাউকে না বলে অজানার উদ্দেশে রওনা দিলাম। অনেক কষ্টে ইউরোপের অনেক দেশ ঘুরে পৌঁছালাম দক্ষিণ আমেরিকার কোন এক দেশে, সেখান থেকে আমাদের কোথায় নিয়ে গেল বুঝলাম না। তবে শুধু স্প্যানিশ কথাই কানে এল। এরপর পাহাড় আর জঙ্গল পাড়ি দিলাম। পথে খাল, নদী কতই না পেরোলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পরিশেষে দেখলাম, বর্ডারের দ্বারপ্রান্তে, তবে সেটা পার হতে হবে অতি সন্তর্পণে। ভয়ে ভয়ে দিন পার করলাম। রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করে ধীর গতিতে বর্ডার পার হলাম। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরানা আদায় করলাম।
দুঃখের বিষয়, বন্ধু রশিদ আটলান্টিক মহাসাগরে হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো আর জাফর মেক্সিকো সীমান্তের কাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। অবশেষে অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আমার স্বপ্নের দেশে এলাম। এসেই বাস্তবতার মুখে পড়লাম। স্বপ্নসুখের আমেরিকায় এসে কত ধরনের কাজ করে যে জীবিকা নির্বাহ করেছি, আর কষ্ট করেছি, তা অবর্ণনীয়। কাগজ ছিল না বলে অনেক ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে ধুিবৎ ধরে সব পেয়েছির দেশে স্থায়ী হতে পেরেছি। তাই এখন এটিই হলো আমার ঠিকানা।

আজ আমার স্বপ্নের দেশে বসবাস করে যখন বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে পেছনে ফিরে দেখি, তখন কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি মনের পর্দায় চলচ্চিত্রের মতো ভেসে আসে। এখনো মনে পড়ে, পালিয়ে পালিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যখন মরিয়া হয়ে পড়েছি, সে সময় একবার মনে হলো দেশেই ফিরে যাব। এই অনিশ্চিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আমার স্বপ্নের দেশ ছেড়ে স্বদেশে পাড়ি দেব। সে সময় আমার রুমমেট, একটি কনভেনিয়ন স্টোরের মালিক আমিন ভাই আমাকে বললেন, মন খারাপ না করে আশায় বুক বাঁধো, খুব শিগগিরই অ্যামনেস্টি দেবে। কিন্তু সেই দিন আর এল না।

এখানে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তার মধ্যে লক্ষ করলাম, একমাত্র ঠিকানা পত্রিকায় নানান খবরের সঙ্গে জানা যেত কোথায় কোন চাকরি খালি আছে। পত্রিকা কেনার মতো কোনো ডলার ছিল না আর থাকলেও তা খরচ করতে চাইতাম না। কারণ, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডলার পেতাম। তবে খবরের জন্য কাগজ পড়তে আমিন ভাইয়ের দোকানে গিয়ে ঠিকানা কাগজটি দেখার চেষ্টা করতাম। শেষ পর্যন্ত এই পত্রিকায়ই আমার ঠিকানার সন্ধান দিল। সে এক মজার ঘটনা। সেখানে একটা খবর ছাপা হয়েছিল ওপি-ওয়ানে এখানে থেকে অনেকে আবেদন করেছিল। পরে ওপি-টুর সময়ও একই ঘটনা ঘটল। আমিও আবেদন করলাম কিন্তু বিধি বাম কপালে আমার এ দেশে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকল না। মনও ভেঙে গিয়েছিল। শেষে আমার প্রিয় পত্রিকা ঠিকানা কিছু অ্যাটর্নির খবর দিয়ে জানাল, যাদের কাগজপত্র নেই তাদের ওই অ্যাটর্নিরা সাহায্য করছেন। আমিও এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। শেষ পর্যন্ত সেই অ্যাটর্নিই আমার মুশকিল আসান করে দিল। মনে মনে ঠিকানাকে ধন্যবাদ দিতে ভুললাম না। কারণ, সেই কাগজটি আমাদের মতো অনেকের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। যদি সেদিন সেই খবর ছাপা না হতো, তাহলে আমরা হয়তো হতাশ হয়ে দেশে ফিরে যেতাম। যদিও খবরটি এমন কিছুই নয়, তবু আমাদের মতো বৈধহীনভাবে যারা এখানে বসবাস করছে, তাদের যে কী দুর্দশা, তা আর বলে বোঝানোর নয়।
তাই আমি এখন বলি, আমার জীবনের ঠিকানা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর আমার প্রিয় পত্রিকা হলো সাপ্তাহিক ঠিকানা।

লেখক : কলামিস্ট ও সংগঠক।