দিল্লির অ্যাজেন্ডায় তৎপর ঢাকা

ডলার সংকটে রুপির টান : এখনো মেলেনি টপ সিগন্যাল

বিশেষ প্রতিনিধি : রাজনৈতিক অরাজকতার মাঝে নানান জোড়াতালিতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে ফেলেছে দুষ্টচক্র। ডলার নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রুপি নিয়ে টানাহেঁচড়ায় নেমেছে তারা। একদিকে ডলারের চড়া দাম, অন্যদিকে নতুন করে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলারে নেওয়া ঋণের সুদহার বৃদ্ধি। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সাত দফায় সুদহার বাড়িয়েছে। এতে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার ধার করতে সুদহার বেড়ে ৯ শতাংশে উঠেছে। দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণসুবিধা দেওয়া অনেক বিদেশি ব্যাংক সময়মতো পাওনা অর্থ না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চাপ দিতে শুরু করেছে। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য যা সেরের ওপর সোয়া সেরের বিষফোড়ার মতো। এই সঙিন অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারতের টাকা-রুপিতে লেনদেন প্রক্রিয়া চালুর পুরোনো মন্ত্র বাস্তবায়নের তোড়জোড়। এত রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ ডলার বেঁচে যাওয়ার হিসাব বগলে নিয়ে ঘুরছে চক্রটি। ভারতীয় ভিসায় ডলারের বদলে রুপি এনডোর্সের বুদ্ধি গেলানোর অঙ্কও বেশ জোরদার। হিসাব কষে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এতে বছরে কয়েকশ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে বাংলাদেশের।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুতের অর্ধেকেরও বেশি। বিশাল অর্থনীতির দেশ ভারতের জন্য তা সামান্য, নেহাতই নগণ্য। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য অনেক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সেই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য।
আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। তার ওপর ভারতের রিজার্ভের সমস্যা নেই। ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা আছে দেশটির। বাংলাদেশের অবস্থা করুণ। দুই দেশের মধ্যে টাকা-রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু হলে বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ ডলার বেঁচে যাবে। ডলার সংকটেও পরিত্রাণ পাবে দুই দেশ। মাসখানেক আগে প্রস্তাবটি দিয়েছে ভারত। রুপিতে বাণিজ্যের দিল্লির প্রস্তাবের বিপরীতে টাকায় বাণিজ্যের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। বিষয়টি প্রস্তাব আকারে থাকলেও গত কদিন এ নিয়ে ব্যাপক তাড়াহুড়ো। আগ্রহীরা পারলে তা আজ বা আগামীকালই কার্যকর ফেলে।
সরকারি মহলের কাছে এটি ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ হবে। আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’। রুপি থেকে ডলার বা ডলার থেকে রুপিতে কনভার্টেবল না হয়ে রুপি থেকে টাকা এবং টাকা থেকে রুপিতে কনভার্ট। এ ‘সিম্পল ম্যাথ’ বাস্তবে কতটা ‘সিম্পল’, তা ভাবার সময়ও দিতে চাচ্ছে না ইন্টারেস্টেড গ্রুপটি। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পড়েছে ফাঁপরে। কারণ অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ তারাই। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো ব্যাংক থেকে আবেদন বা অনুরোধ পায়নি। প্রস্তাবনাটি আলোচনা হয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রীর ভারত সফরকালে। তা-ও আলোচনা পর্যন্তই। এ ছাড়া ভারতীয় মুদ্রা রুপি এখন আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস- এসডিআরে যুক্ত হয়নি। সেখানে অনুমোদন আছে শুধু ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড। আগ্রহীরা সেই তালিকায় রুপি যোগ করানো নিয়ে দেশি-বিদেশি নানান চ্যানেলে মহাব্যস্ত। বর্তমান বিশ্ব স্নায়ুচাপের ফাঁকে এ চেষ্টায় তা করে ফেলার বিষয়ে বেশ আশাবাদী তারা। কিছুদিন রুশ মুদ্রা রুবল নিয়েও ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল এ মহলটি। তাদেরই এখনকার ব্যস্ততা ভারত থেকে দ্রুত আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জোগাড় করার। প্রস্তাব পাওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রীর অবস্থান অস্পষ্ট। কোনো দিকেই মত দিচ্ছেন না তিনি। কারণ, বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের ঝুঁকি তিনি ব্যক্তিগতভাবে অবহিত একজন ঝানু ব্যবসায়ী হিসেবে। বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমানের ভারতীয় রুপি গ্রহণ ও পরে তা বন্ধ করে দেওয়ার তথ্য তার জানা। এ ছাড়া বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকলের পাশাপাশি এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে দেশে ডলারের কেবল দাম বাড়েনি, সংকটও তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম।
এমন পরিস্থিতিতে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভারত। রাশিয়া, মরিশাস, ইরান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এখন বাংলাদেশকেও আশা করে। এ ব্যাপারে তাদের চেয়েও উতলা বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী মহল। ভেতরে ভেতরে তারা অনেক দূর এগিয়েও গেছে। তবে ক্ষমতার টপ মোস্টের মনোভাবের কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে কিছুটা অস্থির হলেও হাল ছাড়ছে না। বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ইতিমধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন করার আইনি বাধা দূর করেছে। ভারত সরকার চায় আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির কদর বাড়াতে। ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়াও এ পথ ধরেছে। বিকল্প পথ হিসেবে দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা দেন, ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে চাইলে ইউরো বা ডলার নয়, দিতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে পরিষ্কার হিসাব ছিল- ইউরোপের দেশগুলো ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। এ দাওয়াই কাজে দেয় এবং রুবলের মান বাড়তে থাকে। ভারতীয় রুপির মান বাড়াতে বাংলাদেশের ডলার সংকটের এই সময়ে ভারতও সেই পথ ধরেছে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। তখন সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার আশা দেখছে। বাংলাদেশের বিজনেস কমিউনিটির একটা বিরাট অংশের চাওয়াও তা-ই। তারা অঙ্ক কষে দেখাচ্ছে-শোনাচ্ছে বাংলাদেশের নানা লাভের হিসাব।