দিল্লি-ওয়াশিংটনের ধাঁধায় ঢাকা : ভাষার মাসে কূটনীতির ভাষার মারপ্যাঁচ

বিশেষ প্রতিনিধি : কূটনীতির খেলায় উতরে উঠেও আবার কাত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। নির্বাচন বিষয়ে বিদেশিদের কোনো কথা শুনবে না জানানোর পরও আবার শুনতে হচ্ছে। নেতিয়েও পড়ছে কারও কারও কাছে। ভারত ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার মতো করে ‘পাশে আছে, থাকবে’ জানানোর পরও হেলছে কয়েক দিকে। বন্ধুত্বের ডামি দিচ্ছে। গোলমালও পাকাচ্ছে। সর্বশেষ এর রিহার্সাল হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি। বিদেশিদের নিয়ে এবার ভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাশিয়া, কেনিয়া, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা হয় সেখানে। ঢাকায় অবস্থান করা অন্যান্য বিদেশিদেরও জড়ো করা হয় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ভাষা দিবসে আয়োজন করা অনুষ্ঠানটিতে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে দলীয় কর্মসূচিতে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি জানিয়ে গরম সংবাদে আসেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। হাততালিসহ ব্যাপক বাহবা পান। সামান্য কিছুক্ষণ পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় বাংলাকে এই মুহূর্তে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তাব দিচ্ছে না বাংলাদেশ। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করতে হলে বছরে ৮০০ কোটি টাকা খরচ পড়বে জানিয়ে বাতাস ঘুরিয়ে দেন তিনি। একুশের পরদিন ৫ দিনের সফরে ঢাকায় আসছে জার্মান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল।
৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলটির সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিক, ব্যবসায়ী এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে বসার কথা। তাদের অ্যাজেন্ডা মানবাধিকারসহ নারী উন্নয়ন, অভিবাসন, বাণিজ্য, উন্নয়ন সহযোগিতা। এর আগে সরকারকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাতটি দেশের প্রতিনিধিদল ‘সাফ কথা’র মতো বলে গেছে, তারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখার অপেক্ষায়। এরও আগে রোহিঙ্গা ইস্যুকে মূল বিষয় দাবি করে সফর করে গেছেন প্রভাবশালী মার্কিন প্রতিনিধি ডেরেক শোলে। তিনিও দিয়ে গেছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের মধুর সম্পর্ক চলছে বলেও জানিয়ে যান। বক্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরে দেওয়া হবে বলে জানানো হয় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে দূতাবাস ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছে, ‘শোলে রোহিঙ্গা ইস্যু, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব এবং মানবাধিকার সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহযোগিতা এবং একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা, অবাধ, সুষ্ঠু এবং সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।’
মার্কিন দূতাবাস রহস্যজনক বার্তাটি দিয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি আরেকটি পোস্টে। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশস্থ দূতাবাস ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশকে উদ্দেশ করে শুনিয়েছে জর্জ ওয়াশিংটনের স্মরণীয় বাণী : ‘সকল জাতির প্রতি সরল বিশ্বাস এবং ন্যায়বিচার পালন করুন। সকলের সাথে শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তুলুন’। দিনটি তাদের দেশে প্রেসিডেন্ট দিবস। এই দিনে এবং ভাষার মাসে বাংলাদেশের উদ্দেশে কেন এমন কূটনৈতিক ভাষা? এ নিয়ে চাপা প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক মহলে। ৬৫ বছর বয়সী ওয়াশিংটন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা করেছেন। দেশে সুশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির স্থাপনেও সচেতন এই সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক। যুক্তরাষ্ট্র জর্জ ওয়াশিংটনের আরো কোনো দিক বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়েছে কি না, এ বিশ্লেষণও আছে।
এর বিপরীতে ভাষার মাসে ভারতের কূটনৈতিক ভাষা সরকারের জন্য আশা-জাগানিয়া তথা শুভবার্তা। চারদিকে চাউর হচ্ছিল, এ সরকারের বিষয়ে ভারতের মতিগতি আগের মতো নয়। ভারত সামনে আওয়ামী লীগের পক্ষে আর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮-এর মতো ভূমিকা নেবে না। এমন গুঞ্জনের মাঝে গোলকধাঁধার মধ্যে ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে’ জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোত্রা। যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিক্রিয়ার ভাষায় সরকার বা বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করলেও ভারত সরাসরি বলেছে ‘শেখ হাসিনা’র কথা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। আবার বাংলাদেশে পূর্ণ গণতন্ত্র থাকার চাপও দিচ্ছে। আর ভারত বলছে, শেখ হাসিনার পাশে থাকার বার্তা। দুই দেশের চাওয়ার মাঝে কূটনৈতিক ভাষাগত তফাত বেশ। ‘বাংলাদেশ’ আর ‘শেখ হাসিনা’ সম্পূর্ণ ভিন্ন ও দুই অর্থ কূটনীতিকদের কাছে।