‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : মনটা খুবই খারাপ। গত ৩ মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর পেয়েছি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সারা দিন টেলিফোন হাতে বসে রয়েছি। লন্ডনের সময় রাত পৌনে ১০টায় খবর পেয়েছি তিনি একবার চোখ খুলেছিলেন। তবে সংকট কাটিয়ে ওঠেননি। চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।

আমি সব আন্তরিকতা নিয়ে প্রার্থনা করছি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট এবং ছোট ভাইয়ের মতো ওবায়দুল কাদের যেন শিগগিরই ভালো হয়ে ওঠেন। পূর্ণস্বাস্থ্য নিয়ে আবার জাতির সেবায় এবং দেশের সেবায় ফিরে আসেন। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনিও আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। তিনিও আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিলেন। লন্ডনে আমরা দীর্ঘদিন এক সঙ্গে বাংলাদেশে সামরিক ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম।

ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো দীর্ঘদিনের। আমি দেশে থাকাকালে যখন অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন থেকে। ওবায়দুল কাদের বাংলার বাণীর সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল। এ জন্য জেল-জুলুম খেটেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দুর্গম পথের সহযাত্রী। তার রাজনীতি নিষ্ঠা ও তারুণ্যের সাহসে ভরা। এ জন্য আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের কাজে ঠিক সময়ে ওবায়দুল কাদেরকেই শেখ হাসিনা বেছে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল ও প্রাচীন বটগাছ থেকে ‘কাউয়া’ তাড়াতে ওবায়দুল কাদের তার সাহস দেখিয়েছেন এবং গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ে তার অবদান অনেক।

কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, সৈয়দ আশরাফকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি; ওবায়দুল কাদের যেন দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং দেশের রাজনীতিতে নৌকার হাল ধরেন। চতুর্থ দফা আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর সরকার ও সংগঠন আরো শক্তিশালী করার পক্ষে শেখ হাসিনার যে ধরনের যোগ্য সহকর্মী দরকার, ওবায়দুল কাদের তাদের একজন। অসময়ে দেশ তাকে হারাতে চায় না। এ জন্য সবারই আকুল প্রার্থনা। ওবায়দুল কাদের অবিলম্বে সুস্থ হয়ে উঠুন। আমি সেই সুখবরের আশায় আছি।

আমার দুঃখ, রাজনীতিতে, সাংবাদিকতায় ও সাহিত্যে আমার যারা সমবয়সী তাদের বেশির ভাগই চলে গেছে তো বটেই, যারা আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তারাও চলে যাচ্ছেন। কথা ছিল আমিনুল হক বাদশা আমার ওবিচুয়ারি লিখবেন। আমি তার ওবিচুয়ারি লিখেছি। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন। কিন্তু তার চোখের সামনে যখন সত্যেন দত্ত থেকে শুরু করে তার চেয়ে বয়সে ছোট অনেক কবি চলে গেলেন তখন স্মৃতিভারে আক্রান্ত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।’ আমি ঊর্ধ্ব বয়সে পৌঁছে কথাটার সত্যতা বুঝতে পারছি।

তবে দীর্ঘজীবন পেয়েছি বলেই আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শামসুল হক থেকে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত দীর্ঘ একটা যুগ দেখে গেলাম; বাংলাদেশের ইতিহাসে যে যুগের কোনো তুলনা নেই। আমার সৌভাগ্য, আমি এই ইতিহাসের একজন সাক্ষী। অতীতে রাজনীতির দুর্গমগিরি কান্তার মরু পার হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা ছিলেন। এ যুগে তাদের শূন্যস্থান পূরণের মতো যোগ্য নেতার আবির্ভাব দেখছি না। শেখ হাসিনাই এখন একমাত্র এই বিরাট শূন্যতা পূরণ করে আছেন।
গত শতকে বাংলাদেশে যোগ্য নেতা অনেক জন্মেছেন। শেখ মুজিব তো তাদের মধ্যে মাথা উঁচু করা তালগাছ। এই তালগাছের ছায়ার তলে জন্ম নিয়েছিলেন আরো অনেক নেতা। তারা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতি সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের দ্বারা এত কলুষিত ও অনুর্বর হয়ে পড়ত না। পঁচাত্তর সালের ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতাকে কারাবন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করাও ছিল বাংলাদেশকে প্রকৃত রাজনীতি ও রাজনীতিক শূন্য করার ষড়যন্ত্রের অংশ।

স্বৈরাচারী শাসকদের গুরু সে কথা তো উচ্চকণ্ঠেই ঘোষণা করেছিলেন। এই গুরু জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা দুঃসাধ্য করে তুলব।’ রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা তিনি দুঃসাধ্য করেছেন। রাজনীতি থেকে তিনি প্রকৃত রাজনীতিকদের বিতাড়ন করেছেন। রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। জাল পীরের মতো জাল রাজনীতিবিদে দেশ ভরে ফেলেছেন।

জিয়াউর রহমান থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশে এ যুগটা প্রকৃত রাজনীতি আর রাজনীতিকদের জন্য এক অনুর্বর যুগ। যে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্ম নেয়, তাদের লাইসেন্স পারমিটবাজি, সন্ত্রাস ও অপরাজনীতিতে ঢুকিয়ে বিপথগামী করা হয়। স্বৈরাচার-সৃষ্ট অপরাজনীতিতে আদর্শ ও নৈতিকতা বর্জিত হয়। রাজনৈতিক শক্তির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় লোভ, দুর্নীতি, পেশিশক্তি ও অর্থশক্তি। এই অন্ধকারের মধ্য থেকে যে শূন্যতার জন্ম, সেই শূন্যতায় অনেক অপদেবতা তৈরি হয়েছে। তাই বাংলাদেশে ‘তারুণ্যের প্রতীক’ বলে উচ্চারণ সম্ভব হয়েছে এক দুর্বৃত্তের নাম। বিদেশে পলাতক এই দুর্বৃত্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। এটা যদি ঘটত, তাহলে বাংলাদেশে আফগানিস্তানের অতীতের ‘বাচ্চা-ই-সাক্কোর’ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো।

বাংলাদেশকে এই আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেছে তার দীর্ঘকালের সংগ্রামী ইতিহাস। এই সংগ্রামের লেগাসি বহন করেই আওয়ামী লীগ একাধিক মৃত্যু-উপত্যকা পেরিয়ে এখনো টিকে আছে এবং জাতীয় রাজনীতির সুস্থতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা থেকেই বিপথগামী তারুণ্য থেকেও কিছু তরুণ নেতা এখনো বের হয়ে আসছেন এবং অতীতেও এসেছেন, যারা মুষ্টিমেয়, কিন্তু অন্ধকারে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে এবং এক দল নীতি ও আদর্শ বর্জিত জাল নেতাকে অপরাজনীতিতে টেনে এনে একটি ভাড়াটিয়া সুধীসমাজ তৈরি করে যারা ভেবেছিলেন, দেশে সৎ ও নীতিনিষ্ঠ গণরাজনীতির অবসান ঘটানো হলো; অপরাজনীতি হবে দেশের ভাগ্যের নিয়ামক, তারা কিছুদিনের জন্য সফল হলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধপ্রসূত জাতীয় রাজনীতির ধারায় হাসিনা-নেতৃত্বের অভ্যুদয় এবং সংগ্রামী তরুণদের একটা অংশ (মুষ্টিমেয় হলেও) সেই নেতৃত্বে সংগ্রামের পথে অবিচল থাকায়।

নতুন নেতৃত্ব তৈরির এই বন্ধ্যত্বের যুগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির উত্তরাধিকার থেকে নতুন কিছু নেতা বেরিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফ, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ রয়েছেন। আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে তরুণদের মধ্য থেকে আরো কিছু নতুন মুখ বেরিয়ে এসেছেন। তারা সবাই যে ভালো ও বড় নেতা হবেন, সে কথা বলি না। তবে দু-চারজন যে যোগ্য নেতা হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। হাসিনা-নেতৃত্বের একটা বড় গুণ এই যে স্বৈরাচারী শাসকরা জাতীয় রাজনীতির যে সুস্থ ধারার প্রবাহ বন্ধ করে রাজনীতিতে নতুন মুখ ও নতুন নেতার আবির্ভাব বন্ধ করেছিলেন, হাসিনা সেই ধারাটা খুলে দিয়েছেন। তার এবারের মন্ত্রিসভা গঠনেও দেখা গেছে, সুস্থ ও শুভ রাজনীতিতে নেতা তৈরির বন্ধ্যত্ব দূর করে আবার নতুন মুখ ও নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাবের পথ খুলে দিচ্ছেন তিনি।

মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতি অচল হয়ে পড়ে, যদি তাতে অব্যাহত স্রোত না থাকে এবং প্রতিটি প্রজন্মেই নতুন নেতৃত্ব জন্ম না নেয়।’ বাংলাদেশে স্বৈরাচারীরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্রোতটা বন্ধ করতে এবং তা থেকে নতুন প্রজন্মের নতুন নেতৃত্ব যাতে জন্ম না নেয় তার অপচেষ্টা করেছিলেন। হাসিনা সেই অচল স্রোতটা আবার সচল করেছেন। এতে আশা করা যায়, আমাদের তরুণদের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার এই বন্ধ্যত্বের কাল শিগগিরই কেটে যাবে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফ, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ নতুন নেতৃত্বের সূচনার মুখ। তাই আশরাফের অকালমৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছি। ওবায়দুল কাদেরের গুরুতর অসুস্থতার খবরে শঙ্কিত হয়েছি। এইমাত্র খবর পেয়েছি, তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। আমার আকুল প্রার্থনা, তিনি ভালো হয়ে উঠুন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে একটার পর একটা তরুণ মুখ যেন অকালে বিদায় না নেয়। আর আমার দীর্ঘ আয়ুও যেন আরো অকালমৃত্যু দেখার অভিশাপ বহন না করে।