দু’বছরেও ব্যবস্থা নেয়নি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়

‘দুর্নীতিতেই ডুবেছে ফুটবল’ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন : ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারের বক্তব্য : বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অনিয়ম ও দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা একটি প্রতিবেদন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে এসেছিল এটা সত্যি। এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরে বিভিন্ন কারণে আর তদন্ত কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

মোজাম্মেল হক চঞ্চল : বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ব্যাপক দুর্নীতি, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং ফুটবলকে আবার টেনে তোলার ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ফরিদ আহমেদের স্বাক্ষরিত চিঠি ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু দু’বছর পার হয়ে গেলেও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বকাপ ফুটবলসহ বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খেলার টিকিট উপহার দেয়া ছাড়াও নানা উপঢৌকন দিয়েছে বাফুফে। আর এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিটি ধামাচাপা দিয়েছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ছিল, একসময় ফুটবল ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আজ বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ফুটবলের এ রুগ্ন অবস্থার জন্য বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন দায়ী। বর্তমানে ক্রিকেটসহ অন্যান্য ক্রীড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অথচ ফুটবল অঙ্গন বাংলাদেশের জন্য অপমান বয়ে নিয়ে আসছে। যার কোনো কারণ থাকা উচিত নয়। প্রতিবেদনে ফুটবলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য বেশক’টি কারণ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে ফুটবল ফেডারেশনের ঋণ করা টাকায় জুয়ার আসর, সভাপতির অদূরদর্শিতায় বাংলাদেশের জরিমানা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের প্রাইজমানি এবং প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়া করার নামে দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ভাঙিয়ে ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টের টিকিট দুর্নীতি, বাফুফের সভাপতি ও মাহফুজা আক্তার কিরনের যৌথ দুর্নীতি, সভার কার্যবিবরণী নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি, বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম, সিলেট বিকেএসপি ক্যাম্পাসে ফুটবল একাডেমির নামে দুর্নীতি, ফিফার প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক আস্ফালন উল্লেখযোগ্য।

এসব দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার চরম পর্যায়ে উপনীত কাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে শিগগিরই প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকারের ভাবমূর্তি ও ফুটবলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। সেই সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন করে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের অর্জিত সম্পদের সঠিক হিসাব নির্ণয় করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমাজের নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি কাজী সালাউদ্দিনের দুর্নিবার আসক্তি রয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। বিষয়গুলো একান্ত ব্যক্তিগত হলেও তার এ নৈতিক স্খলন বাফুফেকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে বলে অনেকেই মনে করেন। বাফুফের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায়ই বড় অঙ্কের টাকা উঠিয়ে কাজী সালাউদ্দিন বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে সময় কাটান বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। আর এ অপকর্মে তাকে সহযোগিতা করেন বাফুফের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার আবু হোসেন। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সুযোগ না পাওয়া দলগুলো নিয়ে সলিডারিটি কাপের আয়োজন করে এএফসি। কিন্তু নিশ্চিত ভরাডুবি জেনে কাজী সালাউদ্দিন ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলকে না খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার এ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে এএফসি বাংলাদেশকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে নেপাল চ্যাম্পিয়ন হলেও তাদের প্রাইজমানি পরিশোধ করা হয়নি। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাঈম সোহাগের যোগসাজশে বাফুফের সাধারণ সভায় আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট রিপোর্টে ওই প্রাইজমানিসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ দেখিয়ে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে প্রাইজমানির প্রতীকী চেক নেপাল দলকে দেয়া হয়। কিন্তু সালাউদ্দিন গং প্রাইজমানি পরিশোধ না করায় পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ক্ষুণœ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়ার নামে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছিল। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের প্রচার স্বত্ব কিনেছিল চ্যানেল নাইন। চুক্তি অনুযায়ী চ্যানেল নাইনের কাছ থেকে পাওয়া টাকা কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি বিশেষমহল আত্মসাৎ করেছে। শুধু তাই নয়, টুর্নামেন্টের টেলিকাস্টিং যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় একটি কোম্পানির (রিয়েল ইমপেক্ট প্রাইভেট লি) সহযোগিতায় ওই টাকা আত্মসাৎ করে বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ইউরো-২০১৬ ফুটবলের খেলা দেখার কথা বলে ওই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচের দুটি করে চারটি টিকিট সংগ্রহ করে বাফুফে। সূত্রে জানা যায়, চারটি টিকিটের প্রতিটি ১০ হাজার ডলার করে ৪০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেন কাজী সালাউদ্দিন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন মিলে একটি দুর্নীতি চক্র গড়ে তুলেছেন। তাদের দু’জনের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী বাফুফের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মো. আবু হোসেন। কাজী সালাউদ্দিনের সহযোগী হিসেবে মাহফুজা আক্তার কিরনের মতো আবু হোসেনও বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ইস্টার্ন ব্যাংক লি (মতিঝিল শাখা, অ্যাকাউন্ট নং ১০২১০৫০০০০৪৭৮৭) এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডে (মতিঝিল শাখা, অ্যাকাউন্ট নং-১০৮১১১০০০১৬৯৪৮) থাকা আবু হোসেনের অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে। এসব লেনদেন মূলত কাজী সালাউদ্দিনের কাছ থেকে পাওয়া দুর্নীতির অর্থের অংশবিশেষ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি মানিলন্ডারিংয়ের আরও অনেক আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। বাফুফের বিভিন্ন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যবিবরণী সংশ্লিষ্ট সবার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হলেও পরে বাফুফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যোগসাজশে গোপনে পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত কার্যবিবরণীর আলোকে প্রচুর টাকা লুটপাট করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়।

বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা জমা ও উত্তোলন নগদে হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চেকের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি বাফুফের লেনদেনে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে ইঙ্গিত করে। এ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নগদ জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে কাজী সালাউদ্দিন গং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সিলেটে বিকেএসপিকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ফুটবল একাডেমিতে পরিণত করা হয়। মূলত একাডেমির যাবতীয় উন্নয়ন কাজ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। অথচ গোপন সূত্রে জানা যায়, ওই ফুটবল একাডেমির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বাফুফের নিজস্ব বলে প্রদর্শনের মাধ্যমে কাজী সালাউদ্দিন গং ব্যাপক দুর্নীতি করছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাফুফের অডিট রিপোর্ট সম্পর্কে বলা হয়, বাফুফের ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। ফিফার সভাপতির এক দিনের খরচ দেখানো হয়েছিল ৯০ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৪ টাকা। জানা যায়, বাংলাদেশ সফরে সভাপতির যাবতীয় খরচ ফিফাই বহন করে। বাফুফের দেখানো খরচের তথ্য সঠিক নয়। কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা করেননি বা করতে সক্ষম নন। বরং তিনি নানাবিধ স্ট্যান্টবাজি করেন। ২০১১ সালে তিনি আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসিকে বাংলাদেশে আনেন এবং বাংলাদেশের ফুটবল একটি গ্লোবাল প্লাটফর্মে প্রবেশ করছে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। অথচ ভুটানের মতো দেশের কাছে হার বাংলাদেশ ফুটবলের মৃতপ্রায় অবস্থাকেই এখন জানান দেয়। কাজী সালাউদ্দিনের স্ট্যান্টবাজি বাংলাদেশ ফুটবলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থা এবং জাতীয় লজ্জাকে লাঘব করতে পারেননি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের কারও কোনো মতামত গ্রহণ না করে এককভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে তিনি রাজনৈতিক আস্ফালন প্রকাশ করেন।