সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অকার্যকর * ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দুর্নীতির মহোৎসব * নতুন করে আলোচনায় ঢাকা ওয়াসার এমডি
ঠিকানা রিপোর্ট : ৫১ বছরে দেশ এগিয়েছে বহুদূর। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুঁচিয়ে উন্নয়নশীল, এরপর মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। একসময়ে যা ছিল স্বপ্ন, সেই পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানী ঢাকায় চালু হয়েছে মেট্রোরেল। চারদিকে শুধু উন্নয়নের জোয়ার। কিন্তু সেই বাধভাঙা জোয়ারে গা ভাসিয়েছে ‘মহাপরাক্রমশালী’দুর্নীতি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না দুর্নীতির। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। কুম্ভকর্ণের ঘুম যেমন ভাঙে না, তেমনি দুর্নীতি প্রতিরোধের চেয়ে বরং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাংলাদেশ। চারদিকে যখন দুর্নীতির সরগরম খবর, তখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে ঢাকা ওয়াসার এমডির যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ির মালিকানার খবরটি। হাইকোর্ট এ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)।
তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ির খবর যখন প্রকাশিত হয়েছে, ঠিক একই সময় আরেকটি খবর এসেছে পত্রিকায়- সম্পদ বিবরণী জমা না দেওয়ায় দুদকের মামলায় কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। ৯ জানুয়ারি সোমবার চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ মুনসি আব্দুল মজিদের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ তো গেল চুনোপুটির দুর্নীতির খবর। কিন্তু ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না দুদক। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। আবার দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন। এমন চরিত্রের আর একজনকেও এ দেশে পাওয়া যায়নি।
গত এক দশকে দেশে বেশ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একের পর এক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। আর্থিক খাতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তেমন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি দুদক। কেবল ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ চিত্র।
আর্থিক খাতে অনিয়মের বেশির ভাগই ঘটেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বেসিক ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নিয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।
নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও সাবেক ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক থেকে পাচার হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদার একাই পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার সঙ্গী হিসেবে উঠে এসেছে মেঘনা ব্যাংকের দুই পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন ও অলোক কুমার দাশসহ আরও কয়েকজনের নাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি হল দেশটির একটি চলমান সমস্যা। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় পৃথিবীর তৎকালীন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্থান লাভ করে বাংলাদেশ। ২০১১ এবং ২০১২ সালে দেশটি তালিকার অবস্থানে যথাক্রমে ১২০ এবং ১৪৪তম স্থান লাভ করে, যেখানে কোনো দেশ নম্বরের দিক থেকে যত উপরের দিকে যাবে ততই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে গণ্য হয়। ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায় ভোগবাদী মানসিকতাই দায়ী।
বাংলাদেশে বর্তমানে সব শ্রেণির ব্যক্তিই ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। তবে উচ্চপর্যায়ের কর্তারা মূলত তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে গিয়ে ঘুষ গ্রহণকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করে। মধ্যবিত্তরা ও নিম্নবিত্তরাও তাদের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। দেখা যায় যে প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষ ঘুষ খেয়ে থাকে।
গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির মতে, শুধুমাত্র ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমান অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে আসবাব কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে ১৬৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলে, যেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা, প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি ৭৬০ টাকা, কভারসহ কমফোর্টারের দাম ১৬ হাজার ৮০০ টাকা এবং বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়। বালিশকাণ্ডের পর দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকায় কেনা নিয়ে আবারো গণমাধ্যম সরব হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম নিয়ে ১৫ দিনে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
সিলেটের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (এসএফসিএল) লোহার এক কেজি নাটের দাম কোটি টাকা এবং বল্টুর দাম অর্ধকোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়। সরকারি অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে এভাবে ক্রয়ের বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়।
এদিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে নিয়োজিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির ক্ষমতা দুদক সচিবের হাতে দেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ৭ জানুয়ারি শনিবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানিয়ে ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
গত ১৮ ডিসেম্বর দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ–বিষয়ক আদেশের বিষয়টি উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, দুদককে সাবেক ব্যুরোর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার অপপ্রয়াস হিসেবে পদায়ন ও বদলির ক্ষমতা দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের হাত থেকে সরিয়ে সচিবের হাতে ঢালাওভাবে ন্যস্ত করা হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) প্রধানমন্ত্রীর যে ঘোষণা, সেটি পদদলিত করার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের হতাশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত হিসেবে এ আদেশকে বিবেচনা করে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী দুদকের নির্বাহী ক্ষমতা চেয়ারম্যান ও তাঁর নেতৃত্বে কমিশনারদের হাতে অর্পিত। এই ক্ষমতা সচিবের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি কী প্রক্রিয়ায়, কোন যুক্তিতে হলো? কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার শঙ্কার বিষয়টি কতটা বিবেচিত হয়েছে? এ সিদ্ধান্ত কি কমিশনের সজ্ঞানে গৃহীত, নাকি এত দিন যে এই সংস্থাকে ‘নখদন্তহীন বাঘ’ বলা হতো, সেটার বাস্তবে রূপান্তর করার এক অশুভ প্রয়াসের ফসল, এমন প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, এই আদেশের ছ অনুচ্ছেদের ৪ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢালাওভাবে দুদক আইনের ১৬ ধারার আওতাভুক্ত সব এখতিয়ার বাস্তবায়নের ‘পূর্ণ ক্ষমতা’ সচিবের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি দুদকের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার জনপ্রত্যাশার কফিনে শেষ পেরেক মারা ছাড়া আর কিছু নয়।
কমিশন কেন নিজের হাতে থাকা ওই ক্ষমতাসহ আরও কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ এখতিয়ার সচিব তথা আমলাতন্ত্রের হাতে নিরঙ্কুশভাবে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, সেটিরও স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান।