মারুফ খান : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধুই কবি নন, গীতিকার নন, শিল্পী নন, নাট্যকার নন, ঔপন্যাসিক বা অভিনেতা নন; তিনি নিবেদিত রাজনীতিকও। তার রাজনীতির কারণে নতুন প্রজন্ম আজ জনগণের জন্য নিরন্তর রাজনীতিক হিসেবে বয়ে চলছে ছাত্র-যুব-জনতাকে সাথে নিয়ে। এই রাজনীতি সাম্য-সুন্দর-স্বচ্ছতা আর নান্দনিকতার। প্রকৃত কবিরা দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে মহাকাল ও মহাদেশের অবারিত সীমায় স্বমহিমায় টিকে থাকেন। কবির একটি দেশ, নিজস্ব ভাষা এবং লোকজ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার থাকে। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের কবি বাল্মীকি থেকে শুরু করে এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় দেখা যায়নি। এ কারণে প্রায় প্রতিটি দেশ ও জাতির মধ্যেই নিজস্ব কবিদের নিয়ে জাতিগত গৌরব ও আত্মপরিচয়ের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আছে। একটি জাতির ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মূলত একজনকেই জাতীয় কবি বা সাহিত্যিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। ইরানে ফেরদৌসীর পাশাপাশি রুমি, সাদি, ওমর খৈয়াম, রুদাকি অনেক মহাকবির জন্ম হলেও শাহনামার বদৌলতে মহাকবি ফেরদৌসীকেই জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। এর অর্থ এই নয় যে, অন্য কবিরা গৌণ বা ছোট। দেশের কোনো কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সাথে জাতির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। যে কারণে ফেরদৌসী ইরানের জাতীয় কবি, রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় কবি, ইকবাল পাকিস্তানের জাতীয় কবি, শেক্্সপিয়ার ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি, হুইটম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি, খোশাল খান খাট্টক আফগানিস্তানের জাতীয় কবি, মাহমুদ দারবিশ প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি। ঠিক একই কারণে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। যদিও কালোত্তীর্ণ সব কবির কবিতা ও শিল্পীর শিল্পকর্ম বিশ্বের সব মানুষের সম্পদ। তবু জাতীয় কবির কবিতা ও সাহিত্যকর্ম জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসকে ধারণ করে থাকে। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী আল্লামা ইকবালের কবিতা ‘সারা জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা’ ভারতের অন্যতম জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হলেও ইকবাল ভারতের নন, পাকিস্তানের জাতীয় কবি। আবার ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করলেও আমাদের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুল ইসলাম। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে শোষণ-বৈষম্যহীন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল কবি নজরুলের স্বপ্ন ও সাধনা। নজরুলের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক বিরলপ্রজ সাযুজ্যের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার কবিতা ও গানে যেভাবে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটেছে, চর্যাগীতিকার কবিদের থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আর কোনো বাঙালি কবির মধ্যে এমন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। জাতির এক চরম ক্রান্তিকালে হিন্দু ও মুসলমানের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবাবেগ তুলে ধরার এমন কৃতিত্ব একমাত্র নজরুলের।
বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমানদের একটি অবিভক্ত রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা এখন একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার বিষয়। বিশ শতকের একেবারে শুরুতে যারা পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠনের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই সাতচল্লিশে অনেকটা নীরবেই বাংলার দ্বিখণ্ডতা মেনে নিয়েছিল। ভিন্নভাবে বলা যায়, বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মনোজগতে বিদ্বেষের দেয়াল সৃষ্টিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল, আলাদা রাষ্ট্র গঠন ছাড়া তা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ হয়তো খোলা ছিল না। প্রথমত, বৃহৎ ভারত থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের পাকিস্তানে যোগ দেওয়া; দ্বিতীয়ত, দুই দশকের মধ্যেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মধ্যেই এই বাংলার মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও নজরুল কখনো খণ্ডিত স্বাধীনতা প্রত্যাশা করেননি। তিনি একটি ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত সৌভ্রাতৃত্বের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নজরুলের জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে ছিল তার সাচ্চা ইমানদারি মুসলমানিত্ব। যুগের অগ্রবর্তী অনন্য প্রতিভাবান মহৎ মানুষদের বেশির ভাগই স্বকালে এবং স্বদেশে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়ে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে দেখা গেছে। নজরুল এর অন্যতম দৃষ্টান্ত।
কবি নজরুলের রাজনীতি ও দর্শন নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তাকে ক্রমশ সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার রাজনীতিক হিসেবে আবিষ্কার করেছি বারবার, কেননা নিরন্তর রাজনীতিক হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে সত্যিকারের রাজত্ব যারা করেছেন, নজরুল তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। তিনি আত্মনিবেদনের কবিতায় বাংলা সাহিত্য যখন সুখ-রঞ্জিত-অনুমথিত-সুরললিত, ঠিক তখন বেসুরো এক আগুন-বাঁশি হাতে বাংলা কবিতা-ভুবনে অবিনীত-ঔদ্ধত্যে প্রবেশ করেন বেখাপ্পা এক তরুণ হিসেবে; ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম মননশীলতার সাথে তৈরি করেছেন নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে নিজের মতো করে বদলে নিয়েছিলেন সব। শব্দ-বাক্য বুননে তিনি নিজেই সৃষ্টি করলেন ভিন্ন পথ। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি যুগ কিংবা একটি শতাব্দী। কবি নজরুল জন্মেছিলেন ব্রিটিশ কলোনি ভারতবর্ষের অনুন্নত গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে। যে গ্রামটি চেতনার নির্ণিমিখে পশ্চাৎপদই বটে। তার পিতা ছিলেন মাজারের খাদেম। তার মায়ের তুলনা ছিল শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত তৎকালীন সমাজের অন্যান্য নারীর মতোই। দরিদ্র পিতার মৃত্যুর পর কিশোর নজরুলের কাঁধে পরিবার ও নিজের জীবিকার দায় চলে আসে। তাকে যুক্ত হতে হয় পিতার কর্মক্ষেত্রে। কৈশোরোত্তর জীবনের উত্তাল সময়ে কবি নজরুলকে ভোগ করতে হলো পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানবিক বঞ্চনা। আর তাই তিনি নতুন করে ভাবনার রাস্তায় হাঁটা শুরু করেন। তিনি নির্মাণ করেন নতুন প্রজন্মের জন্য উদাহরণ। তাও আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা লোভ-মোহহীন নজরুল ধর্মীয় আবরণে মোড়া সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় বাতাবরণে তার বেড়ে ওঠা। একসময় তার গৃহ ও কর্মগণ্ডি ছেড়ে লেটো দলে যোগদান এবং ছন্দোবদ্ধ গান রচনা তার বঞ্চিত জীবনে ছন্দ ফেরাতে ব্যর্থ হলেও উচ্চকিত সাহস জোগাতে ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। নজরুলের বাঁধভাঙা জীবনের সূত্রপাত হয়তো সেখান থেকেই। এই লেটো দলের অনুপ্রবাহই হয়তো তাকে গ্রাম ছেড়ে আসানসোল এনেছিল। তার আসানসোল-জীবনের একটি মোড় ছিল রফিজউল্লার সাহচর্য। যার স্নেহে তিনি ১৯১৪ সালটি জুড়ে এক বছর সময়ের জন্য ত্রিশালের দরিরামপুরে থাকার এবং সেখানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি ফিরে আসেন নিজ গ্রামে এবং রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজস্কুলে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত পাঠলাভ করেন। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট না দিয়ে তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯১৭ সালের শেষ দিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ পর্যন্ত আড়াই বছরের সৈনিক জীবন ছিল তার। তিনি সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হয়েছিলেন। সেখানেও তিনি প্রমাণ করেছিলেন, যদি কারো ইচ্ছে থাকে প্রবল, সফলতা তার আসবেই। একই সাথে এটাও প্রমাণ করেছিলেন, যখনই ইচ্ছে হবে বিশ্ব, দেশ বা মানুষ সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে, তখনই বইয়ের পাতায় চোখ রাখলে মন ভালো থাকবে, জানার সুযোগ বাড়বে।
রাজনীতির জন্য নিবেদিত থাকা কবির প্রতিটি লেখায় আছে ছাত্র-যুব-জনতার মুক্তির কথা; জেগে ওঠার কথা। কেননা অদম্য জ্ঞানপিপাসু কাজী নজরুল ছিলেন নিরন্তর পরিবর্তনে বিশ্বাসী। যে কারণে রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত থাকার পাশাপাশি সৈনিকাবস্থায় রেজিমেন্টের একজন পাঞ্জাব মৌলভির কাছে ফারসি শেখেন। সংগীতানুরাগী প্রশিক্ষিত সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি সংগীতচর্চা করে নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেন। পদ্যে-গদ্যে সাহিত্য এবং রাজনীতিচর্চায় তার শুরু সৈনিক জীবনে। করাচির সেনানিবাসে অবস্থানকালে তার সাহিত্যচর্চা ইতিহাস হয়ে আছে। তবে সেখানে তার রাজনৈতিক জীবন-চিন্তা বিকাশের সুযোগ ছিল না।
১৯২০ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের ডামাডোলময় এক অর্বাচীন সময়ে নজরুল কলকাতায় আসেন। কলকাতার নানা বৃত্ত ঘুরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কার্যালয়ে স্থিত হন মফস্বল এবং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা তরুণ নজরুল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ একদিকে ছিল কলকাতার সাহিত্য-জংশন, অন্যদিকে রাজনীতির। সে সময় বাংলায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ কমরেড মোজাফফর আহমদ সে অফিসের একজন কর্ণধার ছিলেন। তার সংস্পর্শে এই চিন্তারাজ্যের তীর্থকেন্দ্রে নজরুলের রাজনীতির হাতেখড়ি বলে ধরে নেওয়া যায়। নজরুল কলকাতায় আসার পূর্বকাল থেকেই ভারতের মুসলিম সমাজ অভিনব রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। সে সময় ভারতীয় মুসলমানদের কাছে খলিফা বলে মান্য ছিলেন তুরস্কের সুলতান। তুরস্ক খলিফা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করেন। ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয়। ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যেরও (অটোম্যান সাম্রাজ্য) পতন ঘটে। সমগ্র অটোম্যান সাম্রাজ্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় এবং বিজয়ী শক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত হাইকমিশনে তুরস্কের সুলতানকে বন্দী রাখা হয়। এ ঘটনার পর ভারতবর্ষের মুসলমানরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তুরস্কের খিলাফত রক্ষার জন্য ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় আন্দোলন শুরু করে। মাওলানা মহম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯২০ সালে এই কমিটি তুরস্কের সুলতানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে দাবিনামা পেশ করে। এ ক্ষেত্রটি সে সময় ভারতীয় মুসলমানদের জন্য শাখের করাততুল্য হয়ে ওঠে। ভারতীয় মুসলমানরা নীতিগতভাবে ব্রিটিশ শক্তির পক্ষে ছিল। কিন্তু অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন এবং সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হলে আদর্শগত কারণে তাদের ব্রিটিশ শক্তির বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়। এ সময় ইংরেজ সরকার কর্তৃক মুসলিম সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করে তোলার মতো আরেকটি ঘটনা কানপুর মসজিদে ঘটে। সে মসজিদে ইংরেজ সরকারের পুলিশ বাহিনী আক্রমণ করে। এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ শতগুণ বেড়ে যায়। ফলে বাংলার মুসলমানরাও খিলাফত আন্দোলনে যুক্ত হয়। অনেক প্রগতিশীল কমরেডরাও সে সময় খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের আগেই, যে সময় নজরুল রাজনীতির ভুবনে যুক্ত হন, সেটি ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী রাজনীতি-চেতনার বিকাশ কাল। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠিত হয় ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষক সংগঠন হিসেবে। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগও ব্রিটিশ সরকারকে তুষ্ট করার বাইরে বিশেষ ভূমিকা রাখেনি। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এ সংগঠন দুটি ১৯১৬ সালের পর থেকে মর্যাদাবান হয়ে উঠতে থাকে। ১৯২০ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে বাংলায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটি গঠিত হয়। ঢাকার শাহবাগে মুসলিম লীগের ভিত প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি বাংলায় তখন উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল না। সে সময় দর্শনগত দিক থেকে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্য এ সংগঠন দুটির ছিল না। ব্রিটিশ শাসন মেনে নিয়ে দল দুটির কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কল্যাণ চিন্তার মধ্যেই সীমিত ছিল। সে কারণে সে সময় একই ব্যক্তি একসঙ্গে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকতেন। এ ক্ষেত্রে ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দর্শন ছিল স্পষ্ট। নজরুল প্রত্যক্ষভাবে ১৯২৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর দলের একনিষ্ঠ সেবক হয়ে তিনি মেদিনীপুর, হুগলি, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে স্বরচিত স্বদেশি গান ‘ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চর্কা ঘোর’ পরিবেশন করেন, সে কবিতাটি ছিল তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তিনি এ সময় কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত হন। তিনি শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময় কবিতার বাইরে রাজপথে তার দীপ্ত পদচারণ ছিল। নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ প্রকাশের একটি উদ্যোগ ছিল ১৯২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘লাঙ্গল’ পত্রিকার প্রকাশ। তিনি এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকাটিই ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিসচেতন পত্রিকা। এ পত্রিকায় শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের মেনিফেস্টো প্রকাশিত হয় এবং তাতে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি প্রথম উত্থাপিত হয়। ‘লাঙ্গল’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি সাম্যবাদী কবিতা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় তার সর্বহারা কবিতাগুচ্ছও প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯২৭ সালে কলকাতার প্রথম বামপন্থী সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’র জন্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল অবলম্বনে ‘জাগ অনশন বন্দী’ এবং রেড ফ্লাগ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান রচনা করেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির এই ঘোরময় মুহূর্তে নজরুল দর্শনগত দিক থেকে কখনো কমিউনিজমের শরণাপন্ন, আবার কখনো ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসের। তার চেতনায় একদিকে আলোড়িত ছিল পুঁজিবাদের কশাঘাতে বঞ্চিত মানুষের মুখ-সেখানে তিনি হয়েছেন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দ্যোতক, সেখানে তার আশ্রয় হয়েছে সমাজতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি হয়েছে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব। তার চেতনার অন্যদিকে ছিল শৈশব-কৈশোর-যৌবনে বেড়ে ওঠা রক্ষণশীল ধর্মীয় বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে তার আদর্শ হয়েছেন তুরস্কের কামাল পাশা। কবিতার দুটি সত্তা-প্রেম এবং বিদ্রোহের মতো নজরুলের রাজনৈতিক দর্শনও দ্ব্যর্থক। তবে নজরুল কখনো রক্ষণশীল ছিলেন না। তিনি মুক্ত চেতনায় বিশ্বস্ত ছিলেন। সে কারণে ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তবুদ্ধি আন্দোলন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় বার্ষিক দুটি সম্মেলনে যোগ দেন। এ আন্দোলনকে কেবল সাহিত্য আন্দোলন বললে এর তাৎপর্যকে খাটো করা হবে, এ আন্দোলনের সামাজিক গুরুত্বও কম ছিল না। কাজেই সম্মেলনে যোগদানের বিষয়টিও নজরুলের রাজনৈতিক দর্শনের অসীমায়িত দিকটিকে স্পষ্ট করে। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল পূর্ববঙ্গের প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাকে বঞ্চিত করে। পরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করেন। এ সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালান। কিন্তু সে নির্বাচনে তিনি বিজয় লাভ করতে পারেননি। রাজনীতির জগতে আত্মপ্রতিষ্ঠা না পেয়ে পরবর্তীকালে নজরুল কবিতার জগতে আত্মনিবেদন করেন।
কবি কাজী নজরুলের রাজনীতি আমাদের জন্য, নতুন প্রজন্মের জন্য শুধু অনুকরণীয় বা অনুসরণীয় নয়; লেখক ও কবি হাসানুর রশীদের তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নজরুল ছিলেন কিংবদন্তি। তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলতে চায় অবিরত তারুণ্যের রাজনীতিকেরা। কেননা নজরুল যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছেন, সে কর্মকাণ্ডই এখনো নতুন প্রজন্মের পাথেয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্য থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বারবার রাজনীতির দরজায় কড়া নেড়েছেন। যেভাবে এখন নতুন ধারা বাংলাদেশ সারা দেশে সোচ্চার রাজনীতিক গড়ার জন্য নিবেদিত থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় কবি, আমাদের রাজনীতিরও কবি। তিনি ছিলেন বলেই ‘বিদ্রোহী’ হতে শিখেছে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ। তিনি লিখেছিলেন বলেই ‘সাম্যবাদ’ গড়তে তৈরি হয়েছে বাংলার মানুষ। আজ যখন তিনি নেই, তার কর্ম আছে। তার কর্মকে দেখে দেখেই খইফোটা রোদ্দুরে রাজপথ কাঁপাতে তৈরি জাতীয়তাবাদী নতুন ধারার রাজনীতিকেরা। কেননা তারা জানে-নজরুল যে পথ দেখিয়ে গেছেন, নতুন প্রজন্মের জন্য সেই পথই হলো একমাত্র মুক্তির ধারা।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, সংগঠক ও মানবাধিকারকর্মী।