বাহারুল আলম :
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ফলিয়েজ (Fall Foliage) দেখতে নিউইয়র্ক শহরের বাইরে যাওয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১৫ অক্টোবর, রোববার, দুপুর বারোটার দিকে আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। গাড়ি চালাচ্ছিলো আমার পুত্র। দিনের আবহাওয়া ছিলো চমৎকার রৌদ্রকরোজ্জল, তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি। রওয়ানা হয়ে আমরা প্রথমে স্থানীয় একটা কফি শপ থেকে সবার জন্য কফি এবং ডিম দিয়ে তৈরি ব্যাগেল স্যান্ডউইচ নিয়ে নেই পথে খাওয়ার জন্য। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আমরা হোয়াইট স্টোন ব্রিজ, হাচিনসন পার্কওয়ে পেরিয়ে ইন্টারস্টেট ৮৪ ধরে ক্যানেটিকাটের ড্যান বারি (Danbury) শহরের দিকে যেতে থাকি। পেছনে ফেলে আসি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত লং আইল্যান্ড সাউন্ড জলাশয়, যা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে বেরিয়ে এসে ইস্ট রিভারে গিয়ে মিশেছে। এই জলাশয়টি মাছ ধরা এবং নৌবিহারের জন্য একটি বিশেষ নামকরা স্থান।
কিছুটা পথ পেরোতেই চোখে পড়ে রাস্তার দু’পাশের অপূর্ব বর্ণময় অরণ্যরাজির দিকে। গ্রীষ্মে বৃক্ষরাজির সবুজ পাতা হেমন্তের আগমণে রূপ বদলে নানা রং, যেমন, টিয়া সবুজ, লাল গোলাপি, মেরুণ, হলুদ ইত্যাদি বর্ণ ধারণ করেছে।
অসংখ্য বৃক্ষের এহেন বর্ণিল রংছটা এক অপরূপ, নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে, যা ছিলো রীতিমতো মনোমুগ্ধকর (Absolutely beautiful)। আমরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেসব দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। শীতের প্রকোপে অনেক পাতা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে নিচে ঝরে পড়ছিলো। বেশ কিছু গাছকে দেখলাম পত্র-পল্লবহীন কংকালসদৃশ রূপে। সময়ের পরিক্রমায় এক সময়ে সব বৃক্ষই এ রূপ ধারণ করবে। এটা দেখে তরুণ বয়সে পড়া ইংরেজ কবি শেলীর Ode to west wind কবিতার কথা মনে হলো। শেলী লিখেছেন, If winter comes, can spring be far behind, অর্থাৎ যদি শীত চলে আসে, তাহলে বসন্ত কী পিছিয়ে থাকতে পারে। নিউইয়র্কের Autumn বা Fall দেখে শেলীর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হলো, If summer is here, can autumn be far away, অর্থাৎ গ্রীষ্ণ এসে গেলে, হেমন্ত কী খুব দূরে থাকতে পারে।
শেলী ছিলেন একজন আশাবাদী মানুষ। শীতে প্রকৃতির জীর্ণ-শীর্ণ দশা তার কাছে বিষাদ ও হতাশার প্রতীক মনে হলেও সামনের দিনে তিনি মানবজাতির জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল বিজয় ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কল্পনা করেছিলেন। পত্র-পল্লবহীন কংকালসার বৃক্ষরাজিতে সময়ের পরিবর্তনে বসন্তে পুনরায় নতুন পত্র-পল্লবের জন্ম হবে। বিবর্তনের এই খেলা চিরন্তন। সবকিছু দেখে সম্ভবতঃ সে কারণেই ভিক্টোরিয়া যুগের ইংরেজ কবি টেনিসন লিখেছেন, ing out the old, Ring in the New অর্থাৎ পুরনোকে সরিয়ে রেখে নতুনকে বরণ করে নাও। তিনি আরো লিখেছেন, Old order changeth, yielding place to new অর্থাৎ নতুনকে স্থান করে দিতে পুরনো নিয়মের বদল হয়।
প্রায় দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ শেষে ড্যানবারি শহরকে পেছনে ফেলে নিকটবর্তী নিউ মিলফোর্ড শহরে এসে পৌঁছলাম। নিউ মিলফোর্ড একটি ছোট শহর। এখানে একটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁর পার্কিং লটে গাড়ি রেখে আমার ছেলে আমাকে দোকানের ভেতর নিয়ে গেলো। সেখানে বাথরুম করে ফেরার সময় দোকান থেকে ফ্রেঞ্চফ্রাই নেয়া হলো, যা আমরা খেতে খেতে নিকটবর্তী লিচ ফিল্ড শহরের ব্যান্টাম লেক (Bantam Lake) এলাকায় গেলাম। এ সময় রাস্তার দু’ধারে বর্ণময় অরণ্যরাজি খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হলো। এই এলাকায় ইউনিয়ন সেভিংস ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখার অবস্থান লক্ষ্য করলাম। বোঝা গেলো এই এলাকায় ব্যাংকটি বেশ জনপ্রিয়, যেমনটি আপস্টেট নিউইয়র্ক এমঅ্যান্ডটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখা যায়। পনেরো-বিশ মিনিট পর আমরা লেক এলাকায় এসে পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করলাম। সবাই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করে লেক ও তার চারপাশের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলো।
পঙ্গুত্বের কারণে আমার হাঁটাচলার সক্ষমতা সীমিত হওয়া আমি গাড়িতেই বসে থাকতে চাইলাম। কিন্তু আমার পুত্র আমাকে এক রকম জোর করেই গাড়ি থেকে বের করে ধরে লেকের বীচ ও বোর্ড ওয়াকে কিছুটা হাঁটিয়ে আনলো। গত বছর আপস্টেট নিউইয়র্কের নিউবার্গ এলাকায় Walkway on the Hudson (ওয়াকওয়ে অন দ্য হাডসন) ফল দেখতে গিয়েছিলাম। সে সময় আমার পুত্রবধূ এমি আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পুরো ওয়াকওয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো। এবার অবশ্য তার কাজ থাকায় সে আমাদের সঙ্গী হতে পারেনি।
ব্যান্টাম লেক কানেকটিকাট রাজ্যের সবচাইতে বড় প্রাকৃতিক লেক। লিচ ফিল্ড ও মরিস শহরের ৯৪৭ একর এলাকাজুড়ে এই লেক বিস্তৃত। ব্যান্টাম লেক এলাকায় কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম। কিন্তু সরাসরি বাড়িতে না ফিরে আমরা ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টি সংলগ্ন ইয়র্কটাউন, ফিস্ফিল ও বেয়ার মাউন্টেন (Bear Mountain) এলাকা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সর্বত্র ফলের দৃশ্য অনেকটা একই রকম। এখানে ক্রোটন ওয়াটার রিজর্ভয়ার (Croton water reservoir) দেখে বেয়ার মাউন্টেন সংলগ্ন পার্পল হার্ট মেমোরিয়াল ব্রিজ এলাকায় এলাম। বেয়ার মাউন্টেন দেখার জন্য এ স্থানটিকে সিনিক পয়েন্ট (Scenic Point) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বহু মানুষকে দেখলাম সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ খালি চোখে, কেউ বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে পর্বতের অপূর্ব দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে। কেউ কেউ ব্যস্ত সেলফোনে প্রকৃতির দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার কাজে। কৌতূহলবশতঃ আমার স্ত্রী পর্বতের নাম বেয়ার মাউন্টেন কেনো হলো- সেই প্রশ্ন আমাকে করলেন। সঠিক উত্তরটা আমার জানা ছিলো না। তা সত্ত্বেও বানিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই বহু বছর পূর্বে যারা এর নামকরণ করেছে, তাদের কাছে কোন না কোনভাবে পর্বতটিকে ভালুকের শুয়ে থাকার মতো দেখতে মনে হয়েছে, যদিও পর্বতটিতে দেখে আমার কাছে সেরকম কিছু মনে হলো না। উত্তর শুনে আমার স্ত্রীর কাছে সেটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে বলেও মনে হলো না।