দেশবান্ধব, জনবান্ধব নয়, ভোটার বান্ধব বাজেট!

বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত ৭ জুন ১০ম জাতীয় সংসদের যে অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। বাজেট পেশের আগে মন্ত্রিসভার সভায় বাজেটটি অনুমোদন লাভ করে এবং বাজেট প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন। অতঃপর প্রচলিত ধারায় ব্রিফকেস হাতে প্রধানমন্ত্রী সহযোগে অর্থমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন।
অবসর গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে ৮৬ বছর বয়েসী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাঁর জীবনের শেষ বাজেট বলে এবারের বাজেট পেশ করেছেন। বাজেট প্রণয়নে জনমত জানতে সহায়তা লাভের জন্য তিনি তার বক্তৃতায় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের কৃষকের বাজেটসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নেতৃস্থানীয় ও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের পরামর্শের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
একটি বাজেট একটি দেশের একটি বছরের আয়-ব্যয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একটি বছর একটি দেশ কীভাবে চলবে, তার খরচ সংকুলানে আয়ের উৎস, ব্যয়ের খাত নির্ধারণ এবং সার্বিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয় দেশবাসীর সামনে।
বাংলাদেশে চলতি বছরটি ভোটের বছর। ডিসেম্বরের কোনো এক সময় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে বলে মোটামুটি স্থির হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেশকৃত বাজেটটি বাস্তবায়ন করবে ৩টি সরকার। যা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রম। হিসেব মতে দেখা যাচ্ছে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা, নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনউত্তর নতুন সরকার। গতানুগতিক ধারায় বাজেট পেশ করা হলেও এ বছরে বাজেটের এটি একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। তবে পরিপূর্ণ বাজেট অভিজ্ঞজনদের মতে বাস্তবায়নযোগ্য কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। বাজেট পেশের সময় সাধারণত সরকারি মহল থেকে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, দিন শেষে অর্থাৎ বছর শেষে সেই আশাবাদ বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না।
বাজেটপূর্ব মন্তব্যে অর্থমন্ত্রী মুহিত উচ্চাভিলাষী এই বাজেট সম্পর্কে বলেছেন, তিনি তার জীবনে এক সময় বাজেট পেশ করতে গিয়ে নিজেকে বিশ্ব ভিক্ষুক বলে মনে করতেন। আর আজকের বাজেট পেশ করতে গিয়ে নিজেকে একজন গর্বিত অর্থমন্ত্রী মনে করছেন। ১২ বারের বাজেট পেশের রেকর্ডধারী অর্থমন্ত্রী এই বাজেটকে কথার কোলাহলে অস্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা না করে অকপটেই বলেছেন, এবার দেশে নির্বাচনী বছর, বাজেটও তাই ভোটার তুষ্টির বাজেট। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের মানুষের বাজেট অভিজ্ঞতা যে গতানুগতিক অভিজ্ঞতা, তাও হোঁচট খেয়েছে। প্রত্যেক বছর বাজেট পেশের পর সরকারি দলের পক্ষ থেকে বাজেটকে মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের দলিল বলে উল্লেখ করা হয়। দাবি করা হয় দেশবান্ধব, জনবান্ধব বাজেট বলে। এবার তার ব্যতিক্রম। এবার দেশবান্ধব, জনবান্ধব নয়, এবারের বাজেট ভোটার বান্ধব। এরকম খোলামেলা কথা বাংলাদেশেই বলা সম্ভব। এবং এরকম কথা বলেও বাহবা কুড়ানো যায়।
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীর পথে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন সামনে রেখে ভোটের বছরে ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেটকে এর বৈশিষ্ট্যর মধ্যে বলা হয়েছে, নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেটে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২৫ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। মূল বাজেটের যে আকার অর্থমন্ত্রী মুহিত দেখিয়েছেন তা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৮.৩ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে তা ০.৩ শতাংশ বেশি। আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। আবার ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা যাবে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)তে। এখানেই বাজেটের ভোটার বান্ধব লক্ষণ ধরা পড়ে। বাজেট প্রস্তাবে বৈদেশিক অনুদান থেকে মাত্র ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা আশা করা হয়েছে।
ভোটার বান্ধব এই বাজেটে আয় ও ব্যয়ে সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। মোট যে জিডিপি, এই ঘাটতি সেই জিডিপির ৫ শতাংশের মতো। এ ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সহায়তা দেখিয়েছেন। যাতে বিরাট এক ঝুঁকির আশঙ্কা রয়ে গেছে। আসলে বাজেটের ঘাটতি পূরণ সব সময়ই ঝুঁকির বিষয়। বাংলাদেশের মতো আর্থিক সক্ষমতার দেশসমূহে সেই ঝুঁকি থেকে যায় আরও বেশি। এর ফলে ব্যাংকসমূহের তারল্য সংকটের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সরকারি বন্ডের উপরও চাপ পড়ে। ফলে এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বড় রকমের চাপ মোকাবেলা করতে হয় সবকিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায়। এই বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশে আগামী অর্থবছরে যে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি অর্জন করার প্রত্যাশা করছেন তাতে স্বপ্নভঙ্গও ঘটতে পারে বলে অভিজ্ঞজনে আশঙ্কা করছেন।
অন্যদিকে বাজেটকে ভোটার বান্ধব বলা হলেও এমন কিছু পণ্যের দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে যাতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন। সব ধরনের চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করার ফলে আমদানি করা চালের দাম বাড়বে। ছোট ফ্লাটের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। পোশাক, ফার্নিচার, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবার মূল্য বাড়বে। পুরোনো ফ্লাটের পুনঃনিবন্ধন ২ শতাংশ সমভাবে বাড়বে বিধায় তার দামও বেড়ে যাবে। যার চাপ বইতে হবে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষদেরই। সারাদেশকে ডিজিটালাইজড করার প্রয়াসও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। কেননা গুগল, ফেসবুক ইউটিউবসহ ই-কমার্স ব্যবসায় কর চাপানো হচ্ছে।
বিগ বাজেট নিঃসন্দেহে শুনতেও ভালো লাগে। এখন আর গরিব দেশের মানুষ বলে মনে হয় না। কিসিঞ্জার বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন তার তলাবিহীন ঝুড়ি এখন কী বিশাল সম্পদশালী দেশ। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মুহিতের অহংকার আর আনন্দের সীমা নেই। অহংকার আর গৌরব নিয়ে চলতে কার না ভালো লাগে। আমাদেরও গৌরব হচ্ছে। ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট, আনন্দ অবশ্যই হবে। অর্থমন্ত্রী মুহিতের আনন্দের আরও একটি বড় জায়গা রয়েছে। তার সিলেটেরই আরেক ভাই সাইফুর রহমান বিএনপির অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে রেকর্ড এতদিন ধরে রেখে ছিলেন, এবার তিনি সেটা ছুঁয়ে দিলেন। তবু মনের ভেতর একটু আফসোস তার থেকেই গেল। একদল, এক রাজনীতি, এক আদর্শের মানুষ হিসেবে তিনি এই গৌরব অর্জন করতে পারলেন না। যা সাইফুর রহমান করেছিলেন।
এই বাজেট নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং জোট সরকারের উৎফুল্ল হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভোটার বান্ধব বাজেট নিয়ে ক্ষমতার স্বপ্নও দেখতে পাচ্ছেন হয়তো। এমনিতেই বাজেট নিয়ে সরকারি দল সব সময় উচ্ছ্বসিত থাকে রাজ্যজয়ের আনন্দে। এবার একটানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতার স্বপ্ন। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতারা ঠিকই বাজেটের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। প্রস্তাবিত বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট আখ্যায়িত করে একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিএনপির নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিশাল অংকের এই বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির আরেক নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ অর্থমন্ত্রী মুহিতের বাজেটকে একটি নীল রঙের ফাঁকা বেলুন বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, দেশের ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা থেকে উত্তরণে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। ভেতরে কিছু নেই, ফাঁকা। নির্বাচন সামনে রেখে একটি আপসকামী গতানুগতিক বাজেট দিয়েছেন। এ সরকারের এরকম একটি বাজেট দেয়ার অধিকার আছে কিনা সে প্রশ্ন তুলে জনাব মওদুদ বলেছেন, দএ সংসদের ১৫৪ জন সদস্য জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
দেশের সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন রয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ ভোটার বান্ধব বাজেট পায়। ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, আমেরিকাপন্থী, সৌদি আরবপন্থী রাজনীতিবিদ পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য স্বদেশবান্ধব, স্বদেশপন্থী কিছু পায় না। দেশের মানুষ যার প্রত্যাশায় রয়েছে ৪৭ বছর ধরে। বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ হয়েছে। মাথাপিছু আয়, জিডিপি সবই বেড়েছে। কিন্তু একটি আদর্শ রাষ্ট্র হতে পেরেছে কি না, যেখানে আইনের শাসন রয়েছে, মানুষের শান্তি ও স্বস্তি হয়েছে- সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।