দেশের পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচন

বদরুদ্দীন উমর

দেশের পরিস্থিতি যেখানে বছরের পর বছর প্রকৃতপক্ষে অপরিবর্তিত থাকে, সেখানে কোনো বিষয়ে লেখার কাজ এক দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলা অথবা বিদ্যমান পরিস্থিতির সমালোচনা যেখানে অনেকভাবে আইনত নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক, সেখানে যা করা যায় সেটা হচ্ছে দেশে যা চলছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার পক্ষে কথা বলা। এটাই বাংলাদেশে এখন চলছে। এর মধ্যে লেখক, সাংবাদিক, কবি, ইতিহাসবিদ, শিক্ষক থেকে নিয়ে সব ধরনের বুদ্ধিজীবীর নিরাপত্তা আছে, টাকা-পয়সা পকেটে পড়তে থাকার সুযোগও আছে।
এই সুযোগের ব্যবহার বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হচ্ছে। দলীয় কর্মীদের এক সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধু খাওয়ার জন্য যেসব বহিরাগত আওয়ামী লীগে ঢুকে ঝামেলা সৃষ্টি করছে, তাদেরকে দল থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এখন আওয়ামী লীগে মধু আছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একথা বলছেন। কিন্তু মধু যেখানে আছে তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া শুধু মৌমাছির নয়, মানুষেরও স্বভাব। কাজেই যারা মধুর লোভে আওয়ামী লীগে ঢুকছে বা ঢুকে থেকে এবং বাস্তবত অনেক ফায়দা বা মধু লুটছে তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে যা অস্বীকার করার উপায় নেই তা হচ্ছে, সরকারি দলের একটি মধু ভা-ে পরিণত হওয়া। যে সরকার বা দল দেশের জন্য কাজ করবে সেটা মধুভা- হবে- এটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ মধুভা- যেখানে রচিত হচ্ছে সেখানে মধু খাওয়ার ব্যাপারও অবশ্যই থাকে। মধু খাওয়ার জন্যই মধুভা- রচিত হয়, সেটা মৌচাকই হোক অথবা হোক কোনো দল, প্রতিষ্ঠান বা সরকার।
বাংলাদেশ সরকার বা সরকারি দল একটি মধুভা-ে পরিণত হওয়ার কারণে মধুর লোভে আজ যে শুধু বাইরের লোকই, অর্থাৎ এ যাবৎ আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা লোকই, ভেতরে ঢুকে মধু খাচ্ছে তাই নয়, যারা দল বা সরকারের অভ্যন্তরে রয়েছে তারাও বেশ ভালোভাবেই এবং নিরাপদে মধু খাচ্ছে। কাজেই মধু খাওয়াটা কোনো দোষের ব্যাপার নয়। এখানে চিন্তা হচ্ছে মধু কে খাবে? শুধু সরকার বা সরকারি দলের লোক, না তার বাইরের সুযোগসন্ধানী লোকও। সরকার ও দলের মধুভা-ে ভাগ বসাতে যদি বাইরের লোক আসে, তাহলে সরকারি দলের তাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে নদী, পুকুর, সব ধরনের জলাশয় দখল হচ্ছে ও শুকিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সর্বত্র ‘মধু’র বন্যা বইছে। এই মধু যথেচ্ছভাবে লুটপাট হচ্ছে। এই মধুর চরিত্র এবং মধু লুটপাটের ধরন বিচিত্র। মধু বলতে এখানে বোঝাচ্ছে জমি, নদী, সব ধরনের জলাশয়, বনভূমি, শিক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে নিয়ে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। এগুলো সবই মধুভা-। মৌমাছি যেমন নানা ধরনের ফুল থেকে মধু সঞ্চয় করে, তেমনি উপরোক্ত সব মধুভা-ও রচিত হয় সাধারণ শ্রমজীবী, কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তের শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপাদিত উদ্বৃত্ত অপহরণ করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট করে। এই অপহরণ ও লুটপাট বাংলাদেশে এখন চলছে অবাধে ও মসৃণভাবে। অবাধের অর্থ বেপরোয়াভাবে এবং মসৃণভাবের অর্থ কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ও শাস্তির ব্যাপার না থাকা।
১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ধন-সম্পদ অর্জনের সব থেকে সহজ উপায় দাঁড়িয়েছিল চুরি, দুর্নীতি এবং সর্বোপরি লুটপাট। এ দিক দিয়ে অবস্থার যেকোনো পরিবর্তন হয়নি এটা আমরা ক্লান্তিহীনভাবে বলে এসেছি। কিন্তু তার দ্বারা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু চুরি, দুর্নীতি, লুটতরাজের ক্ষেত্র আরও বিচিত্র ও সম্প্রসারিত হয়েছে। আগে যে মধুভা- ছোট ছিল এখন তা বিশাল ও প্রকা- আকার ধারণ করেছে। আর এই মধুভা-ের কল্যাণে বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক এখন কোটি কোটি, শত শত কোটি, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে দেশের শ্রমজীবী গরিবদের বড় আকারে শোষণ করছে। শোষণের প্রয়োজনে তাদের ওপর নির্যাতন করছে, তাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এই সুযোগ যেখানে আছে সেখানে বাইরের লোক ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
তবে আওয়ামী লীগে বাইরের লোক অনুপ্রবেশকে তাদের সংকটের জন্য যতখানি দায়ী করা হচ্ছে, তার জন্য তারা ততখানি দায়ী নয়। আওয়ামী লীগের আসল সমস্যা তার সংগঠনের ভেতরেই। মধুভা- লুটপাটের জন্য বাইরে থেকে যত না লোক আসছে, তারা যত না ঝামেলা সৃষ্টি করছে, তার থেকে অনেক বেশি ঝামেলা বা সংকট সৃষ্টি করছে তাদের সংগঠনের ভেতরকার লোক। কারণ মধুভা- লুটপাটের প্রতিযোগিতার মধ্যে তারা রয়েছে। প্রত্যেক এলাকায় আওয়ামী লীগ তো বটেই, এমনকি ছাত্রলীগ, যুবলীগ থেকে নিয়ে তাদের সব অঙ্গ সংগঠনের মধ্যেই এলাকার প্রভুত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মারামারি চলছে। এই দ্বন্দ্ব¦-বিরোধ-মারামারির ভিত্তি যে নেতাকর্মীদের মধুভা-ে ভাগ বসানোর প্রতিযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধা বেশি করে পাওয়া, এতে সন্দেহ নেই। কাজেই সরকারি দলের আসল সমস্যা সৃষ্টিকারী বাইরের অনুপ্রবেশকারী নয়। তারা হলো, সংগঠনের ভেতরকার লোক। নির্বাচন যদি হয়, তাহলে নির্বাচন সামনে রেখে এই অভ্যন্তরীণ দলাদলি, দ্বন্দ্ব-মারামারি সামাল দেয়াই হলো সরকারি দলের মূল সমস্যা। এ সমস্যার প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ওপর দোষারোপ করলে যে পরিস্থিতির মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে, এটা মনে করার কারণ নেই।
নির্বাচন সামনে রেখে এবার সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়, তাহলে তার জন্য দায়ী হবে তৃণমূল পর্যায়ের লোক সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ ধরনের বক্তব্য খুব ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এর দুটি দিক আছে। প্রথমত, নির্বাচনে জয় সম্পর্কে সংশয়। দ্বিতীয়ত, পরাজয় যদি হয় তাহলে তার দায়দায়িত্ব সরকার এবং দলীয় নীতি ও কার্যকলাপকে নয়, নিম্নস্তরের অর্থাৎ তৃণমূলের ওপর চাপিয়ে দেয়া। এসব থেকে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার। আগামী নির্বাচনে সরকার কী করবে, কিভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে সেটা দেখার বিষয় হলেও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন যে তারা এবার আর করতে পারবে না বা করার চেষ্টা করলে তার মধ্যে যে বড় বিপদের আশঙ্কা থাকবে, এ উপলব্ধি তাদের কিছুটা হয়েছে বলেই মনে হয়।
আগামী নির্বাচন ২০১৪ সালের মতো একতরফা না হলেও এ নির্বাচনও সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। এ জন্য তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্ব¦ী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর তারা অসংখ্য ভুয়া ও হাস্যকর মিথ্যা মামলা দিয়ে রেখেছে। তাদেরকে বেপরোয়াভাবে জেলে আটক করা হচ্ছে, তারা নির্বাচনী প্রচার যাতে ঠিকমতো না করতে পারে তার জন্য তাদেরকে সভা-সমিতি-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ নির্বাচন সামনে রেখে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার তার কিছুই এখন বাংলাদেশে নেই। সাধারণ নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রায় এটাই দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নির্বাচনের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হয় না নির্বাচনের অর্থ জনগণের স্বার্থে দেশ পরিচালনার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। মনে হয়, সরকারি ক্ষমতার অর্থ মধুভা-ের মালিকানা এবং নির্বাচনের অর্থ হয় এই মধুভা- রক্ষা করা, নয়তো ক্ষমতাসীনদের পরাজিত করে মধুভা-ের দখল নেয়া। জনগণের ভোটের দ্বারাই এটা হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, মধুভা- জনগণের হাতের বাইরেই থাকবে, মধুর ভাগীদার নয়, সরবরাহকারী হিসেবে তারা আগের মতো তাদের শ্রম দিয়ে যাবে, নির্যাতিত হবে এবং জীবনের নিরাপত্তা, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে সমাজের নিচের তলায় অন্ধকারের মধ্যেই জীবনযাপন করবে।
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল।