দেশে চাকরি করতে গিয়ে মামলার জালে মার্কিন প্রবাসী

ঠিকানা রিপোর্ট : যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে চাকরি করতে গিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে এক প্রবাসীর। ইচ্ছা ছিল নিজ দেশের জন্য কিছু করবেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও শুরু করেন। যে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন নিজের মেধায় তার অনেক উন্নতিও করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানই এখন কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। স্বপ্নভঙ্গ ওই ব্যক্তির নাম মুনির হোসেন খান। যিনি কর্মরত প্রতিষ্ঠান মালিকের রোষানলে পড়ে এখন জেলেবন্দি। তার বিরুদ্ধে এক বছরে একে একে ২৫টি মামলা করা হয়েছে। হুমকি দেয়া হচ্ছে আরো মামলা করার। প্রবাসী মুনিরের জন্য এখন ভুক্তভোগী তার পুরো পরিবার। এ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সময় কাটছে তাদের।
জানা যায়, মুনি হোসেন খান তার স্কুল জীবনের বন্ধুর অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে কেওয়াই স্টিলে যোগ দিয়েছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্যও বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। ব্যবসায়িক কলেবর আরো বড় হতে থাকলে কোম্পানির পরিচালক হিসেবেও পদায়ন করা হয় তাকে। কিন্তু তার অব্যাহত সাফল্য সহ্য হয়নি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। শুরু হয় দূরত্ব, যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর জের ধরেই হয়রানির শিকার হন স্বপ্নবাজ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুনির। তিনি এখন ২৫টি হয়রানিমূলক মামলার আসামি। যার বেশির ভাগ মামলাই অর্খ আত্মসাতের। এর মধ্যে স্ত্রী জেবুন খান ৯টিতে এবং মুনিরের বাবা চট্টগ্রাম বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন খান একটি মামলা আসামি। ৭৭ বছর বয়সী মোয়াজ্জেম হোসেন খান নিজের নামে এমন হয়রানিমূলক মামলার পরও এখন ছেলের চিন্তায় শয্যাশায়ী। তার পরও ক্ষান্ত হয়নি মুনিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা। সামনে আরো কঠিন মামলা দায়েরের হুমকি আসছে পরিবারের সদস্যদের কাছে। এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে তিন সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে ছেড়েছেন মুনিরের স্ত্রী জেবুন খান।
মুনিরের পরিবার সূত্রে আরো জানায়, মুনির হোসেন খান কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমানের স্কুল জীবনের সহপাঠী। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে বন্ধুর অনুরোধে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশে এসে কেওয়াই স্টিলে যোগদান করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পায় মুনির। ব্যবসায়িক কলেবর আরো বড় হতে থাকলে ২০১০ সালে কোমপানির পরিচালক হিসেবেও (পেইড ডিরেক্টর) পদায়ন করা হয় তাকে।
মুনির হোসেন খান চাকরিতে থাকা অবস্থায় ভারতের আগরতলায় একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে কেডিএস গ্রুপ। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিনিয়োগের জটিলতা থাকায় ওই কারখানার দলিল প্রস্তুত করা হয় মুনিরের নামে। মার্কিন পাসপোর্টধারী হওয়ায় কারখানা স্থাপন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় সুবিধা পেতেই ওই সময় তার নামে দলিল প্রস্তুত করা হয়। ইতিমধ্যে একটি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন কেওয়াই স্টিলের কর্ণধার ইয়াসিন রহমান।
২০১৮ সালের ১১ই এপ্রিল বিকালে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে বাকবিতণ্ডায় কারাবন্দি টিটু প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মুনির হোসেন খানকে মারধর করেন। লাঞ্ছিত হওয়ার অপমানে প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেন মুনির। যোগ দেন অন্য একটি বড় প্রতিষ্ঠানে। নতুন কোম্পানিতে একই পদে যোগদানের পর মুনিরের বিপদ আরো বাড়ে। মুনিরকে ভারতে স্থাপিত কেডিএস ফ্যাক্টরির মালিকানা থেকে শুরু করে সব দলিলাদি স্থানান্তর করতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছাড়ার এনওসি (ছাড়পত্র) পেলেই ফ্যাক্টরির সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন বলে কর্তৃপক্ষকে জানান মুনির। কিন্তু কেডিএস কর্তৃপক্ষ এনওসি দেয়ার বদলে উল্টো মামলার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে গাড়ি চুরির মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা শুরু হয়। একের পর এক মামলা মাথায় নিয়ে একপর্যায়ে জেলে আটক হন মুনির হোসেন খান।
মুনিরের পরিবারের অভিযোগ, মুনিরকে শায়েস্তা করার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ২৫টি মামলা করা হয়েছে। সবক’টি মামলার বাদী কেডিএস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের চিফ অপারেটিং অফিসার জাবির হোসেইন। এসব মামলায় গত এক বছরের বেশি সময় চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি আছেন মুনির। কিছু মামলায় টিটুর পিতামাতাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আসামি করা হয়েছে।
মুনিরের আইনজীবী অলোক কান্তি দাশ বলেন, ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যেসব অভিযোগে মুনিরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেগুলোর বিপরীতে অডিট রিপোর্ট দেখাতে পারেননি বাদী। কেডিএস গ্রুপ একটি বড় প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অডিট টিমও অনেক শক্তিশালী। কোনো ধরনের আত্মসাতের ঘটনা থাকলে তা অডিট রিপোর্টেই পাওয়া যেত। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে।
এসব মামলায় ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে সমপ্রতি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন মনিরের বাবা মোয়াজ্জেম খান। তিনি বলেন, টিটু ও তার পরিবার অনেক প্রতাপশালী। আইন ও প্রশাসন সব তাদের নিয়ন্ত্রণে। আমি তাদের সঙ্গে পারবো না। কিন্তু আমার যা কিছু আছে তার সবকিছুর বিনিময়ে আমি আমার ছেলের মুক্তি চাই। আমার ছেলে আমেরিকার নাগরিক। সে মুক্তি পেলে আমেরিকায় চলে যাবে। এই দেশে আর থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত মুনির হোসেন খানের স্ত্রী জেবুন খান জানান, একের পর এক হয়রানিমূলক মামলায় তার পরিবার বিপর্যস্ত। একজন নাগরিক যত বড় অপরাধী হোক না কেন তার জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বানোয়াট মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে তার স্বামীর জামিন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে মামলার বাদী কেডিএস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের চিফ অপারেটিং অফিসার জাবির হোসেইনের সঙ্গে মঙ্গলবার অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অফিসিয়াল নাম্বারে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কল কেটে দেন তিনি।
তবে নাম প্রকাশ না করে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় চালকের আসনে ছিলেন মুনির হোসেন খান। কোমপানির কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন- একজন লোক যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে নিজ দেশে এসে কিছু করবে, যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু মুনিরের সঙ্গে যা হয়েছে তা খুবই হতাশাজনক।
তবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে কারাগারে এ রকম কোনো সভা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তিনি ডিভিশন পেয়েছেন ঠিক। প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে হয়তো আদালত বা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ডিভিশন পেতে পারেন।